দেশে করোনা ভাইরাসের কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কার নাকি বিভ্রান্তি?

ড. মোঃ সহিদুজ্জামান

করোনা ভাইরাসের আক্রমনে সারা বিশ্ব যখন দিশেহারা তখন কিছু কিছু আশার আলো পাওয়া যাচ্ছে ওষুধ ও প্রতিষেধক আবিষ্কারে। গবেষকরা প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন নতুন এই করোনা ভাইরাসের হাত থেকে মুক্তি পেতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রাথমিক গবেষণায় (গবেষণাগারে-সেল কালচারে) ভাল ফল পাওয়া গেছে এমন একটি ওষুধে করোনা চিকিৎসায় সাফল্যের কথা বলছেন বাংলাদেশে একদল চিকিৎসক।

ওষুধটি মানুষ ও পশুপাখির  কৃমি, বহিস্থপরজীবি  ও অন্তঃপরজীবির কার্যকরী চিকিৎসায় দীর্ঘদীন থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আইভারমেকটিন নামের এই ওষুধটি পরজীবির স্নায়ুতন্ত্র ও কোষের ক্লোরিন অন্ত:প্রবাহের উপর কাজ করে। এই ওষুধটি গবেষণাগারে (ইনভিট্র- সেল কালচারে) করোনাভাইরাসে বিরুদ্ধে কার্যকর ভুমিকা রাখার বিষয়ে কিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে এমনি সময়ে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীর উপর প্রয়োগ করে ভাল ফল মিলছে এমনটাই সাফল্যের কথা দেশের কিছু পত্রপত্রিকায় উঠে এসেছে। তবে ওষুধটি করোনা রোগীর ক্ষেত্রে কতটুকু কার্যকর তা এখনও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

অস্ট্রেলিয়ায় এক গবেষণায় দেখা গেছে, গবেষণাগারে  আইভারমেকটিন উচ্চ মাত্রায় ৪৮ ঘন্টায় ভাইরাসের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজর গুন কমাতে সক্ষম।  গবেষণাগারে (সেল কালচারে) যে মাত্রায় ওষুধটি ব্যবহার করে ফল পাওয়া গেছে সে মাত্রা মানুষের রক্তে অর্জন করতে প্রায় ৩৫ গুন ওষুধ ব্যবহার করতে হবে। আবার ফুসফুসে সেই কার্যকর মাত্রা অর্জন করতে আরও বেশি পরিমানে ওষুধ ব্যবহারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু  মানুষে আইভারমেকটিনের নির্দেশিত ডোজ ২০০ মাইক্রোগ্রাম/কেজি (মুখের মাধ্যমে)  যা কিনা করোনা চিকিৎসায় কার্যকর নয় বলে অন্য এক গবেষণায় ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।

আমেরিকায় করোনা রোগীর উপর যে গবেষণাটি করা হয়েছে তার একটি রিপোর্ট ((জার্ণালে প্রকাশিত নয়) থেকে জানা যায়  আইভারমেকটিন ব্যবহারে  ১.৪% থেকে ৮.৫% মৃত্যুহার কমে যায়। তবে তারা প্রাথমিক এই গবেষণার ফলাফলকে নিশ্চিত করার জন্য র‌্যানডোমাইজড কন্ট্রোল্ড ট্রায়ালের কথা বলেছেন।

জাপানে এটি নিয়ে এখনও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়নি। যাই হোক দু -একটি জায়গায় ট্রায়ালের কথা বলা হলেও সেখানে উল্লেখ রয়েছে যে গবেষণাটি একটি প্রাথমিক ধাপ মাত্র, কোন পিয়ার রিভিউড জার্ণালে প্রকাশিত নয় তাই এটি পরিপূর্ণ কোন গবেষণা বা ফলাফল এবং করোনা চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোন গাইডলাইন বা নির্দেশনা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না । তাছাড়া এ বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কোন নির্দেশাও নেই। অধিকন্তু এই আইভারমেকটিন ওষুধটি বিশ্বব্যাপী পরজীবির জন্য অনুমোদিত হলেও করোনার জন্য এখনও অনুমোদিত নয়।

এমতবস্থায় বাংলাদেশের গবেষকদল যে ট্রায়লটি দিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার তবে তা কতটুকু বৈজ্ঞানিকভাবে মানসম্মত এবং যৌক্তিক না নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। করোনার রোগীর জন্য বাংলাদেশ সরকারের ওষুধ প্রশাসন কর্তৃক স্বীকৃত নয় এমন ওষুধ প্রয়োগ করা ঠিক কিনা সেটিও বিবেচ্য বিষয়।

আইভারমেকটিন এর নির্দেশিত ডোজ ২০০ মাইক্রোগ্রাম/কেজি। ১০ গুন পর্যন্ত অর্থ্যৎ একজন প্রাপ্তবয়স্কের সপ্তাহে সর্বোচ্চ ৬০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত গ্রহণ করার নির্দেশনা রয়েছে। সর্বোচ্চ এই পরিমান ডোজে ওষুধটি রক্তে ও ফুসফুসে কি পরিমান থাকছে এবং সেই পরিমান ওষুধ করোনার ভাইরাসের উপর কার্যকর কিনা এসব বিষয়ে কোন তথ্য প্রমানাদি পাওয়া যায়নি। এছাড়া বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা যাবে কিনা সেটিও বিবেচ্য বিষয়।

এ ড্রাগটি কিভাবে কাজ করে তা এখনও পরিষ্কার নয়। উচ্চ ডোজে এটি কি পরিমানে ক্ষতিকারক তা  মানুষে প্রয়োগের আগে অবশ্যই গবেষণাগারের প্রাণীতে (ল্যাবরেটরি এনিম্যাল) এ পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বিভিন্ন ডোজে এর ফলাফল নির্ণয়, রক্তে ড্রাগটির পরিমান ও অবস্থানকাল, ফুসফুসে এর পরিমান ও অবস্থানকাল, এবং বিভিন্ন তন্ত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিরাপদ ডোজ নির্ণয় করা প্রয়োজন।

দেশের প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তারেক আলম তাঁর চিকিৎসকদল কিভাবে করোনার রোগী বাছাই করেছেন, কন্ট্রোল কেস ছিল কিনা, রোগীর লক্ষণ কি রকম ছিল- প্রাথমিক নাকি গুরুতর অবস্থায় এটি প্রয়োগ করা হয়েছিল,  আইভারমেকটিন এর স্বীকৃত ডোজে কাজ করেছে নাকি অতিরিক্ত ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি। আবার Ethical clearance এর বিষয়টিও রয়েছে এ ধরণের গবেষণায়। তাদের এই গবেষণা বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল স্বীকৃত কোন পিয়ার রিভিডিস জার্ণালে প্রকাশিত হয়েছে কিনা, না হলে এই আপৎকালীন বা জরুরী সময়ের বিবেচনায় বিশেষজ্ঞ কোন বোর্ড দ্বারা এটি যাচাই বা স্বীকৃত হয়েছে কিনা সেটিও একটি বড় বিষয় । এটি যে কোন পরিপূর্ণ গবেষণা নয় তার কোন প্রমান এখনও পাওয়া যায়নি।

এভাবে যখন যে ওষুধের কথিত সাফল্যকথা মিডিয়াতে আসে তখন কিছু মানুষ মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে এসব ওষুধ,  বাজারে দাম  বেড়ে যায় বহুগুনে, অধিক মুনাফা করে নেয় অসাধু ব্যবসায়ীরা।  সে বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। এর আগে ম্যালেরিয়ার ওষুধ ক্লোরোকুইন বা হাইড্রোক্সি ক্লোরাকুইন এবং পরে ভাইরাল জ্বরের ওষুধ রেমডেসিভির করোনায় কার্যকর হিসেবে প্রচারনায় অনেক মানুষ তা স্টক করে রেখেছে। সংকট সৃষ্টি করেছে বাজারে এবং গুরুতর সমস্যা তৈরি করেছে যারা নিয়মিত এসব ড্রাগ সেবন করে থাকেন তাদের জন্য। আমাদের দেশে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই যেখানে সব ধরণের ওষুধ কেনা যায় সেখানে এধরণের বিষয়গুলো মারাত্বক প্রভাব ফেলছে।

পশুপাখির জন্য বাজারে প্রাপ্ত আইভারমেকটিন প্রিপারেশন মানুষ যদি গ্রহণ করে সেক্ষেত্রে মারাত্বক ক্ষতি হতে পারে। অতএব বিষয়গুলো ভালভাবে উপলব্ধি করে এধরণের কথিত গবেষণা ফলাফল প্রচারণা থেকে বিরত থাকা উচিত।

 

প্রফেসর ড. মোঃ সহিদুজ্জামান
লেখক ও গবেষক

তথ্য সুত্রঃ

https://www.thepharmaletter.com/article/ivermectin-can-kill-covid-19-within-48-hours-monash-university-study-finds

http://www.ajtmh.org/docserver/fulltext/10.4269/ajtmh.20-0271/tpmd200271.pdf?expires=1589709541&id=id&accname=guest&checksum=AFFE1B67B7AD2903A7DB43F31628E3DE

https://www.news-medical.net/news/20200427/Ivermectin-alone-not-useful-in-treating-COVID-19.aspx

http://pharmacyservices.utah.edu/alerts/2020/animal-ivermectin-covid-19.php

 

 

 

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3