সাউথ কোরিয়ার শ্রেষ্ঠ তরুণ গবেষক বাকৃবির সাইদুর রহমান

নিজস্ব প্রতিবেদক:
বর্তমান বিশ্বে গবেষণা উন্নয়ন খাতে সাউথ কোরিয়া সর্বাধিক ব্যয় করে থাকে। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্রে দেশটির অভাবনীয় অগ্রগতির ফলে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তির তালিকায় প্রবেশ করছে। জাতির অগ্রগতির জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় সাউথ কোরিয়া কোন রূপ কমতি রাখতে রাজি নয়। প্রতি বছর শিক্ষা ও গবেষণা খাতে উন্নতির লক্ষ্যে ভিনদেশের হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থী ও গবেষকদের সুযোগ দিয়ে থাকে দেশটি। এতে বাংলাদেশের মেধাবীরাও পিছিয়ে নেই। কোরিয়াতে বাংলাদেশের প্রায় এক হাজার শিক্ষার্থী ও গবেষক বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করছেন। যাদের অনেকেই নিজ নিজ পরিশ্রম ও মেধা দিয়ে কোরিয়ার মাটিতে লাল-সবুজের পতাকাকে উজ্জ্বল করে চলেছেন। ড. মো: সাইদুর রহমান তাঁদেরই একজন।

সাউথ কোরিয়ায় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করে তিনি এখন সেখানে শিক্ষকতা করছেন, গবেষণা করছেন। গবেষণার জন্য কোরিয়ায় শ্রেষ্ঠ তরুণ গবেষক হিসেবে সম্মানিতও হয়েছেন। গবেষণার মাধ্যমে তরুণ এই গবেষক এগিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে, পরিচিত করাচ্ছেন প্রিয় বাংলাদেশকে।

ড. রহমান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ (Bangladesh Agricultural University) থেকে ডিভিএম ও এমএস সম্পন্ন করে তাইওয়ানের ন্যাশানাল সান ইয়েত-সেন বিশ্ববিদ্যালয় (National Sun Yet-sen University) থেকে মলিকুলার বায়োলজিতে ডিপ্লোমা করেন। পরবর্তীতে ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার চুং-আং বিশ্ববিদ্যালয় (Chung-Ang University) থেকে পি.এইচ.ডি সম্পূর্ণ করেন। তিনি বর্তমানে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার ও কে.আর.এফ. (Korea Research Fellowship; KRF) পোষ্ট-ডক্টরাল গবেষক হিসাবে সফলভাবে কাজ করছেন। তাঁর গবেষণার বিষয় প্রজননবিদ্যা (Major: biotechnology)।

বিসফেনল-এ (বিপিএ) পৃথিবীব্যাপী বহুল ব্যবহৃত একটি রাসায়নিক পদার্থ। এ পদার্থটি ব্যবহৃত হয় প্রায় সকল প্লাস্টিকজাত সামগ্রীতে। বিপিএ আমাদের শরীরে বোতলজাত খাবার থেকে এমনকি খেলনা, সিডি-ডিভিডি, ব্যাংক ও শপিং মলের রশিদ, ইত্যাদি স্পর্শের মাধ্যমেও শরীরে প্রবেশ করতে পারে। ধারণা করা হয় যে বিপিএ ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ, ডায়বেটিক, হৃদরোগ, স্ট্রোক, প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়া সহ মানুষে নানবিধি রোগ সৃষ্ট করে।

ড. রহমান তাঁর গবেষণায় বিপিএ কিভাবে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে তা আবিষ্কার করেন। এছাড়া, তাঁর গবেষণায় বিপিএ কোন প্রক্রিয়ায় বংশানুক্রমিক ভাবে প্রজনন ক্ষমতা ব্যাহত করতে পারে সেই সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে আসে।

ড. রহমানের এ আবিস্কার বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। সংক্ষিপ্ত শিক্ষা ও গবেষণা জীবনে তিনি নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী চুং-আং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে “শ্রেষ্ঠ গবেষক” এর পুরুস্কার প্রাপ্ত তিনিই প্রথম বিদেশি (প্রতি বছরই বিশ্ববিদ্যালয় একজন ছাত্রকে এ সম্মানে সম্মানিত করে থাকে)। এছাড়া, তিনি কোরিয়ান সোসাইটি ফর ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি থেকে সেরা তরুণ গবেষক (Young Scientist Award) সম্মানে ভূষিত হন।

গত ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, কোরিয়ার ইনহা বিশ্ববিদ্যালয়ে “মহান বিজয় দিবস ও বিসিকে এ্যাওয়ার্ড” অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন কোরিয়া তাঁকে সেরা বাংলাদেশি গবেষকের সম্মানে সম্মানিত করে। তরুণ এ গবেষকের গবেষণা পত্র/বিজ্ঞান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে পৃথিবীর নাম করা ত্রিশের অধিক বিভিন্ন SCI(E) বিজ্ঞান সাময়িকীতে, যা ৪০০ বারেরও বেশি উদাহৃত (cited) হয়েছে। অল্প বয়সেই তার প্রকশনার IF বা ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ১০০.০০ এর বেশি। তিনি আমেরিকা, কানাডা, ও এশিয়ার ২০ টির বেশি কনফারেন্সে যোগ দিয়েছেন।

যদিও সাইদুর রহমানের শৈশব ছিলো অনেক সংগ্রামের, চ্যালেঞ্জের। কৃষক পরিবারে জন্ম। বাবা মো: কায়েম উদ্দীন একজন কৃষক। মা মিসেস ছহিমা খাতুন গৃহিনী। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগে সাইদুর রহমান নাটোরের অজপাড়া গায়ের তিরাইল হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং বনপাড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন।

নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেই পথচলা সাইদুর রহমানের। গ্রামের কৃষক পরিবারে জন্ম হওযায় তিনি দেশের নাড়ি-নক্ষত্রের অবস্থা জানেন। তিনি বুঝেন, বাংলাদেশকে কিভাবে বিশ্ব দরবারে তোলে ধরতে হবে তা। তাই আগামীতে দৃষ্টি সুদূরে তরুণ এই গবেষকের। নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চান। আর বিশ্বব্যাপী পরিচিত করাতে চান নিজ দেশ বাংলাদেশকে।

দেশের গবেষণা জানতে চাইলে স্বল্পভাষী এই গবেষক বলেন, ‘দেশে ভালো রিসার্চ একেবারে হচ্ছে না ব্যাপারটা এমন না। বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা ও সৃজনশীলতা উন্নত বিশ্বের ছেলে-মেয়েদের চেয়ে কোনভাবেই কম না। যেহেতু দেশে গবেষণা খাতে আর্থিক বরাদ্দ তুলনামূলক কম, অগ্রগতিও তাই কিছুটা শিথিল।।’

তার বিশ্বাস, সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা, মেধা, চেষ্টা, ও পরিশ্রমের মাধ্যমে যেমন সকল প্রতিকূলতাকে জয় করা সম্ভব তেমনই মানসম্পন্ন গবেষণাও করা সম্ভব। উদাহারনসরুপ উনি দেশের খ্যতনামা অনেক প্রফেসর/গবেষকদের কথা গর্ব করে বলেন, যারা সীমিত সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও বিশ্বমানের গবেষণা করে যাচ্ছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিষয়ে জানতে চাইলে এই গবেষক জানান, ‘দেশের জন্য কিছু করতে পারলে ভালো লাগবে। আশানুরূপ সুযোগ পেলে দেশে ফিরে দেশের জন্য কাজ করতে চাই।’

তবে বাস্তবতার নিরীখে প্রশ্ন উঠতেই পারে, গবেষণায় এগিয়ে নিতে দেশ কি এই গবেষকের যোগ্য সম্মান দিতে পারবে?

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: