বাবার বিদায় বেলায় সন্তানের চিঠি

জাহিদ হোসেন, কানাডা থেকে:

আজ, ৩০ জুন ২০১৯, আমার বাবা সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন (Syed Sakhawat Husain)-এর অধ্যাপক জীবনের শেষ কর্মদিবস। ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীর্ঘ সময় অধ্যাপনার পর আগামী কাল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে অবসর-উত্তর ছুটি। আজ থেকে প্রায় ৪৪ বছর আগে (১৯৭৫-এর ৮ নভেম্বর) কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশু প্রজনন ও কৌলি বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে শুরু হয়েছিল আব্বার সফল কর্মজীবন। স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষা বর্ষে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করা মানুষটির জন্য শিক্ষাদান ও গবেষণায় নিয়োজিত হওয়াই যে যথার্থ সিদ্ধান্ত ছিল তা তো বলাই বাহুল্য।

অত্যন্ত গর্বের বিষয় এই যে, বর্ণীল কর্মজীবনে আব্বার যা কিছু অর্জন তার পেছনে একমাত্র প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও গবেষণাগত অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভাগীয় প্রধান, প্রাণপ্রিয় পশুপালন অনুষদের ডীন থেকে শুরু করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পর্যন্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে কাজ করেছেন। যে প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্ব নিয়েছেন সেখানেই উনার উদ্যোগী স্বপ্নদর্শী মনোবৃত্তির ছাপ রেখেছেন। ভৌত অবকাঠামোতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় নানা মৌলিক ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। পটুয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বিদ্যালয় – বিভিন্ন পর্যায়ের এই প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উনার সফল কর্মযজ্ঞের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

আব্বার ব্যক্তিসত্তার নানা দিক সেই কৈশোর থেকেই আমাকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে। এর মাঝে আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা এবং উদার প্রগতিশীল দর্শনের প্রতি আব্বার ঐকান্তিক অঙ্গীকার। একজন প্রকৃত আলোকিত মনের মানুষ তিনি। আর সন্তান হিসেবে আমার গর্বের সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র এটাই। আরেকটি মানবিক গুণের কথা না বললেই নয়। আর সেটি হলো আব্বার নিঃস্বার্থ পরোপকারী মনোবৃত্তি। আব্বার সান্নিধ্যে যাঁরাই এসেছেন তাঁরা সকলেই এ বিষয়ে অবগত।

কর্মক্ষেত্রে আব্বার চলার পথ সবসময় মসৃন ছিল না। প্রায়শই নানা চড়াই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পরিবারের সকল সদস্যই নানা প্রতিকুল সময়ের সাক্ষী। এমন সময় এসেছে যে আমরা আব্বাকে তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতে জোরালোভাবে অনুরোধ করতে বাধ্য হয়েছি। বাংলাদেশের বাস্তবতাই এমন দুর্ভাগ্যজনক। ব্যক্তির চিন্তা এবং কাজ যতো ইতিবাচক হবে তাঁকে ততো বেশি নেতিবাচক অপশক্তির মোকাবেলা করতে হবে। কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতেই আব্বাকে নিরাশ বা নিরুদ্যম হতে দেখি নি। প্রতিকুলতা যতো বেড়েছে আব্বার একাগ্রতা ততো বেশি সুদৃঢ় হয়েছে। পরাজয় স্বীকারের পরিবর্তে যে কোনো পরিস্থিতিতে লড়াই চালিয়ে যাবার আব্বার এই সাহসী মানসিকতা দেখে আগেও অনুপ্রাণিত হয়েছি – এখনো অনুপ্রাণিত হই। আব্বার সফল কর্মজীবনের নানা অর্জন সম্পর্কে আরেক দিন বিস্তারিত লিখবো। তবে আজ যে কথাটি না বললেই নয় তা হচ্ছে আব্বার নানা সাফল্যে আম্মার অবদানের অনস্বীকার্যতা। আম্মার সহযোদ্ধাসুলভ মনোভাব অনেক প্রতিকুলতার মাঝেও আব্বাকে বরাবর দৃঢ়চেতা হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সন্তান হিসেবে তাই আমি আম্মার প্রতি কৃতজ্ঞ।

আমি জানি, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা জীবন থেকে অবসর মোটেও আব্বার কর্মজীবনের সমাপ্তি নয়। আজ কেবল কর্মজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে । সহসাই তাঁর কর্মজীবনের নতুন কোনো অধ্যায়ের সূচনা হবে। বরাবরের মতোই তিনি যে কাজেই নিয়োজিত হবেন সেখানেই উনার স্বপ্নদর্শী কর্মযজ্ঞের বর্ণীল ছাপ রাখবেন এবং চারপাশের সকলকে অনুপ্রাণিত করে যাবেন। বাংলাদেশকে এবং বাংলাদেশের মানুষকে উনার আরো অনেক দেয়ার আছে।

আব্বা,
তোমার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তিলগ্নে তোমায় জানাই অনন্ত অভিনন্দন। আর তোমার জীবনের আসন্ন প্রতিটি নতুন অধ্যায়ের জন্য রইলো অশেষ শুভ কামনা। তোমার সকল অর্জনই তোমার প্রাপ্য। শীঘ্রই আমরা একত্রে তোমার এই বর্ণীল সুদীর্ঘ অভিযাত্রার সাফল্য উদযাপন করবো। সেই প্রতীক্ষায় রইলাম।

তোমার গর্বিত সন্তান,
জাহিদ

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3