কুড়িগ্রামের ডিসি ও দেশের ভাবমূর্তি

কাজী এস. ফরিদ

কুড়িগ্রাম এর ডিসির প্রত্যক্ষ মদদে সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে আরডিসির সরাসরি অংশগ্রহণে জেলা প্রশাসনের একটি দলের সম্মিলিত সন্ত্রাসী আচরন সম্প্রতি বেশ আলোচিত হচ্ছে। অনলাইন গণমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের উপর এ সন্ত্রাসী আচরন দেশের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুন্ন করেছে একই সাথে বিস্মিত ও বেদনাহত করেছে । আরিফুল ইসলামকে তাঁর বাড়ি থেকে যেসব লোক দুর্বৃত্তদের মত বেদম পিটিয়ে চোখ ও হাত বেঁধে তুলে নিয়ে গেছেন, দুর্বৃত্তপনা তাঁদের পেশা নয়। বরং তাঁদের পেশাগত দায়িত্ব হচ্ছে, অপরাধীদের হাত থেকে দেশের জনগণকে রক্ষা করা ও সকল প্রকার অন্যায়ের প্রতিকার করা। তাঁরা সেটা না করে নিজেরাই অপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছেন, আইনের রক্ষক হয়ে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। এদের দেশের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।

সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে, সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কুড়িগ্রামের ডিসির মারাত্মক রোষের শিকার হয়েছেন যা চরিতার্থ করতে কথিত মাদকবিরোধী অভিযানের নামে তাঁকে মাদকদ্রব্য রাখার অভিযোগে রাতের অন্ধকারে তাৎক্ষণিকভাবে দণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরিফুলের প্রতি যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাঁর দাবি সেই অভিযোগ মিথ্যা। কিন্তু তা যদি সত্য ও হয়, তাঁর ওপর এই নির্যাতন চালানোর অধিকার আইন প্রয়োগকারীদের নেই। বরং তারা যা করেছে তা স্পষ্টতই অপরাধ ও ক্ষমতার সুস্পষ্ট অপব্যবহার এবং এই ঘটনায় বেশ কিছু অনিয়ম হয়েছে যা জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী নিজেই বলেছেন।

এ ঘটনায় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। সরকারি কোনো সংস্থার কোনো সদস্য আইন লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট সদস্যকে কর্মস্থল থেকে প্রত্যাহার, অন্যত্র বদলি কিংবা সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। আইনানুগভাবে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দৃষ্টান্ত দৃঢ় না হলে এই ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশংকা থাকে। তাই এই সব ঘটনার প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্যে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রত্যাহার যথেষ্ট নয়, তাঁর ও সংশ্লিষ্ট অন্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া খুবই জরুরি।

২০০৯ সালের ঘটনা  আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মাত্র কয়েক বছর হল। আমার এলাকার একটা স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রধান অতিথি আর আমি বিশেষ অতিথি। অনুষ্ঠান শুরুর আগে আয়োজকরা সহ লাঞ্চে বসেছি। শুরু থেকেই ইউএনও সাহেব কথা বার্তায় তাঁর ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করা শুরু করলেন। কথা শুনে মনে হল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি তাঁর এক ধরণের এলার্জি আছে। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি চাইলেই যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারি। উল্টাপাল্টা কথার টুকটাক প্রতিবাদ করা আমার ছোটকাল থেকেই অভ্যাস। তাই আমি বললাম, না পারেন না। তিনি আবার বললেন, পারি। আমি বললাম, বিনা কারণে কাউকে গ্রেফতার করলে আপনিই বিপদে পড়বেন। একপর্যায়ে তিনি বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সব স্টুপিড। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যা। আমি মুচকি হেসে বললাম, তাহলে আপনার কথাই ঠিক। অন্তত আপনাকে দেখে আপনার কথা আমার ঠিক মনে হচ্ছে। তারপর আয়োজকরা (যারা আমার এলাকার মুরুব্বি) চোখের ইশারায় আমাকে চুপ করতে অনুরোধ করায় আমি আর কথা বাড়াইনি। তিনিও অবশ্য আর কিছু বলেননি। এটা হচ্ছে খারাপের উদাহরণ যেখানে ব্যক্তি আত্মরম্ভিতায় মেতেছিলেন, ক্ষমতার নোংরা অপব্যবহার করেছিলেন। এই ব্যক্তির জন্যে এখনো আমার শুধুই করুনা হয়।

২০১০ সালের ঘটনা  আমাকে একজন জুনিয়র কলিগ ও একজন মাস্টার্সের ছাত্রসহ গবেষণার কাজে হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় যেতে হয়েছিল। ময়মনসিংহ থেকে মাধবপুর পৌঁছুতে আমাদের প্রায় রাত ৮টা বেজে গেল। মাধবপুরের এমন একটা জায়গায় (একটা এনজিও’র অফিস, যেখানে আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা ছিল) আমাদের যেতে হবে যেখানে রাত ৮টার পরে যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওই এলাকায় তখন ডাকাতের অনেক উপদ্রব ছিল। আমরা যাওয়ার ২ দিন আগেই ১ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। উপজেলায় খোঁজ নিয়ে হোটেলেও খালি রুম পেলাম না। তো সাহায্যের আশায় থানায় গেলাম। সাধারণত থানার ওসিদেরকে নিয়ে আমাদের যে ধারণা ওই ওসি সাহেব তার ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁকে আমাদের সমস্যার কথা বলে ইউএনও এর মোবাইল নম্বর আমাকে দিতে বললাম। তারপর ইউএনও কে ফোন দিয়ে সমস্যার কথা খুলে বলার পরে তিনি খুব আন্তরিকভাবে বললেন, আপনারা যদি চান তাহলে ডাক বাংলোয় থাকতে পারেন অথবা আপনাদের নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে চাইলে সেখানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। আমি বললাম, আমাদের নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পারলে ভালো হবে। তারপর তিনি ওসি সাহেবের সাথে কথা বললেন। এরপর ওসি সাহেব আমাদের গাড়ির সামনে ও পিছনে দুই গাড়ি পুলিশ দিয়ে আমাদেরকে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দিলেন। এটা হচ্ছে ভালো ব্যক্তিত্বের উদাহরণ যেখানে ব্যক্তি তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছেন। তিনি যে জনগণের সেবক সেটা তিনি ভুলে যাননি যে কারণে আজ এই লেখা লেখার সময় ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করছি। আমি এখন ভাবি এই ক্ষেত্রে যদি প্রথম ঘটনার ইউএনও  বা তার মত অন্য কেউ থাকত তাহলে আমাদের কী অবস্থা হত!

স্বেচ্ছাচারিতা আর ক্ষমতার অপব্যবহার রুখতে হলে কালক্ষেপন না করে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। মানুষের ক্ষমতা যে কত সীমিত তা ‘করোনা’ আমাদেরকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। এখন কারো সাথে একটু হ্যান্ডশেক ও করতে পারছি না, নিজের ঘর থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছি। তাই অহমিকা ও ক্ষমতার দম্ভ ত্যাগ করে মানবিকতার দীক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার কোন বিকল্প নাই।

লেখক: কাজী এস. ফরিদ, সহযোগী অধ্যাপক, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
Email: ksfarid@gmail.com

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3