নিজের ফাঁদেই মরছে কৃষক!

ইসাহাক আলী, নাটোর প্রতিনিধি:
কৃষকদের নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম আর কীটনাশক ছিটিয়ে সতেজ করা সবুজ চারা গাছগুলো এখন পরিপক্ক। পরিপক্ক সেই পেয়াজ গাছের ডগায় এখন সাদা কদম ফুলের সমারোহ। নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার হালতি বিলসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার মাঠে এখন সেই ফুলের মৌ মৌ গন্ধ। দৃষ্টি জোড়া সেই সাদা কদমের সমারোহ। আর এই সাদা কদম ফুলের ভেতরেই রয়েছে কারো কুচকুচে বর্ণের পেয়াজ বীজ। যা এ অঞ্চলের কৃষকদের কাছে ব্ল্যাক ডায়মন্ড বলে পরিচিত।

তবে ফুলের সৌন্দর্য্য যতোই নজরকাড়া হোক না কেন পরাগায়ন না হলে তাতে পরিপক্কতা আসেনা। আর এসব ফুলে পরাগায়নের প্রধান মাধ্যম হলো মৌমাছি। কিন্তু গাছের সুন্দর চেহারা, সতেজ কদম ফলানোর জন্য পোকামাকড় মারতে কৃষকরা যে কীটনাশক ছিটিয়ে ছিলেন। সেই পোকামাকড় মারার ফাঁদেই মরেছে উপকারী পোকা ও মৌমাছি। কৃষকের সেই ফাঁদেই মরতে বসেছে পেয়াজ বীজ চাষিরা। পরাগায়ন না হওয়ায় শুকিয়ে মরতে শুরু করেছে পেয়াজ কদম। ফলন বিপর্যয়ের আশংকা এখন তাড়া করে ফিরছে পেয়াজবীজ চাষীদের।

সমস্যার সমাধানে কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কৃষকরা। দিশেহারা অনেক চাষী কৃষি বিভাগের বিরুদ্ধে বিষোগদার করলেও প্রাকৃতিক এই সংকট পরামর্শ দিয়ে পূর্ণ সমাধান করা সম্ভব না বলে জানিয়েছেন তারা। তবে কৃষি বিভাগের পরামর্শে কৃত্রিম উপায়ে মৌমাছির আগমন ঘটিয়ে সংকট নিরশনের চেষ্টা করছেন চাষীরা। এ বছর ভাল বীজ তৈরি না হলে আগামীতে পেঁয়াজ উৎপাদন ব্যহত হওয়ার আংশকা করছেন তারা।

এলাকাবাসী ও জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এই পেঁয়াজের বীজ থেকেই এই অঞ্চলের কৃষকদের বছরের বড় একটা আয় আসে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই মৌমাছি মারা যাওয়ায় পরাগায়ন না ঘটায় বিপাকে পরেছেন এই কৃষকরা। এবছরও পেঁয়াজের কদম ফুলে মৌমাছির সংকটে পরাগায়ন পর্যাপ্ত না হওয়ায় বীজ উৎপাদনে শংকা দেখা দিয়েছে। পরাগায়নের অভাবে পেঁয়াজের কদম ফুল শুকিয়ে মরে যাচ্ছে। এদিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে অনেক কৃষক কদম ক্ষেতে মৌমাছির বাক্স ভাড়া করে বসিয়ে পরাগায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় , নলডাঙ্গা উপজেলার হালতি বিলের সোনাপাতিল, তেঘড়িয়া, বাশিলা , পাটুল, মাধবপুর ও শেখপাড়া বিলে রোপনকৃত অধিকাংশ পেঁয়াজের কদম ফুলে পর্যাপ্ত পরিমানে মৌমাছি না থাকায় ফুলে পরাগায়ন হচ্ছে না। এ কারণে কদম ফুল শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। এতে পেঁয়াজের কদম ফুলে আশানুরুপ বীজ (বিচি) তৈরি না হওয়ার আশাংকায় দিশেহারা কৃষক।

মাধবপুর বিলের কৃষক শহিদুল ইসলাম জানান,তার প্রায় এক বিঘা পেঁয়াজের কদমের জমিতে মৌমাছির অভাবে পরাগায়ন না হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। তাই তিনি পাবনার দাশুরিয়া মৌমাছির খামার থেকে মাসিক ভাড়া চুক্তিতে ২টি বাক্স এনে কদম ক্ষেতের মাঝখানে বসিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি পেঁয়াজের কদম ফুলে পরাগায়ন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি অভিযোগ করেন কৃষি অফিস ও মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের কোন সহযোগিতা ও পরামর্শ ছাড়াই তারা এ সংকট মোকাবেলা করে যাচ্ছেন।

আরেক কৃষক সাহাদত হোসেন সাধু জানান, মৌমাছির অভাবে পেঁয়াজের কদম ফুলে পরাগায়ন না হওয়ার আশংকায় তিনিও এবার মৌমাছির বাসা ভাড়া নিয়ে ক্ষেতে বসিয়েছেন। এতে মৌমাছিরা পেঁয়াজের কদম ফুলে বসে পরাগায়ন ঘটায় কিছুটা স্বস্তি¡ ফিরে এসেছে। তিনি জানান, এক বিঘা জমিতে ৪০/৪৫ হাজার টাকা খরচ করে দেড় থেকে দুই লাখ টাকার বীজ বিক্রি করা সম্ভব। তার দেখাদেখি আশে পাশের অন্তত ২৫-৩০ জন কৃষক অনুরুপ কায়দায় খামার থেকে মৌমাছির বাসা মাসিক চুক্তিতে ভাড়া এনে কদম ক্ষেতে বসিয়েছেন।

হালতি বিলের সোনাপাতিল গ্রামের পেঁয়াজের কদম চাষী আসাদ আলী জানান, এবার পেঁয়াজের কদম ফুলে একদিকে লেদা পোকার আক্রমন অন্যদিকে মৌমাছির অভাবে পরাগায়ন না হওয়ার ফলন কম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ব্যাপারে নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসার আমিনুল ইসলাম জানান, এবার নলডাঙ্গা উপজেলায় মোট ৬০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের কদম চাষ হয়েছে।

নাটোর কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আলহাজ্ব উদ্দিন আহমেদ জানান, জমিতে অতিরিক্ত ক্ষতিকারক কীটনাশক ব্যবহারে ও মধু সংগ্রহকারীর উৎপাতে দিন দিন মৌমাছি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ায় ও মৌমাছির পরাগায়নের অভাবে পেঁয়াজ বীজে ফলন কিছুটা কম হতে পারে।

এদিকে পোকা মাকড় রোধের নামে কৃষকদের কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ও পরিবেশ নন্ধব উপায়ে আবাদ করতে চাষীরা আরো যতœবান না হলে পেয়াজবীজ উৎপাদনে বিরুপ প্রভাবের আশংকা করেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। এজন্য কৃষকদের সচেতনা বাড়াতে কৃষি বিভাগের তৎপরতা বাড়ানোর দাবী তাদের।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: