তানোরে জলের জমিনে সবুজের গালিচা

মিজানুর রহমান, তানোর সংবাদদাতা:
‘ক্ষেতে-ক্ষেতে লাঙলের ধার মুছে গেছে কতবার,- কতবার ফসল-কাটার সময় আসিয়া গেছে, -চ’লে গেছে কবে!- শস্য ফলিয়া গেছে,-তুমি কেন তবে রয়েছ দাঁড়ায়ে একা-একা! ডাইনে আর বাঁয়ে পোড়ো জমি-খড়-নাড়া–মাঠের ফাটল,- শিশিরের জল!’

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ‘মেঠো চাঁদ’ কবিতা এখন সত্যি হয়ে ধরা পড়ছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার পূর্ব দিকের সীমানা ঘেঁষে ঐতিহ্যবাহী শিবনদীর বিল এলাকায়। যে জমিনে বছরের একটা সময় পর্যন্ত দিগন্তে যতোদূর চোখ যায় কেবল পানি আর পানি, সেই জমিনে এখন যতোদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। যেন কোনো ভোঁজবাজিতে পানি উবে সেখানে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে নিরাকার সবুজের গালিচা। ফলে শুকনো বিলের প্রতিটি এলাকা হয়ে উঠেছে পানি আর সবুজের এক অপূর্ব সম্মিলন। একই জমি কৃষকদের তলিয়ে দেয়, ভাসিয়ে নেয়। আবার সেই জমিতেই ফলানো সোনা হয়ে ওঠে এখানকার বাসিন্দাদের জীবনের পাথেয়। এমনকি, পানির রাজ্যে এখন ফসলের জন্য দিতে হয় পানি সেচ। বিলের পরিবেশ-জীবন সংগ্রামের এ বৈপরীত্য, প্রকৃতির এই বদল নিয়ে শিবনদীর বিলে হয়ে উঠেছে মন্ত্রমুগ্ধ এক মর্ত্য।

সরেজমিনে শিবনদীর বিলের বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখন বর্ষার সেই টই-টম্বুর রূপ নেই। নেই পানিতে-পানিতে ভাসমান দ্বীপ সদৃশ জনপদ। সেখানে এখন আদিগন্ত সবুজের গালিচা পাতা। মাঠের পর মাঠ ধানের আবাদ। ফাগুনের শুরুতে এই সবুজের বিলে ধানের এই রূপ পুরো বিলকে করে তুলেছে অনিন্দ্যসুন্দর।

উপজেলার চান্দুড়িয়া, কালিগঞ্জ, বুরুজ, গোল্লাপাড়া, ধানতৈড়, চাপড়া, গোকুল,তালন্দ,কামারগাঁসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বর্ষার পানিতে ডুবে থাকা এ বিলের বেশিরভাগ জায়গা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সেখানে এখন ব্যতিব্যস্ত কৃষকরা। ফসলের পরিচর্যায় উদয়-অন্ত পরিশ্রম করছেন তারা।

উপজেলার বিল পাশ্ববর্তী শতাধিক গ্রামের মানুষদের একমাত্র ফসল বোরো ধান। প্রতি বছরের কার্তিক মাস থেকে বোরোর আবাদ শুরু করেন বিল ধারের তানোরবাসী। কার্তিক- অগ্রহায়ণ এই দুই মাস খেতে ধানের চারা রোপণ করেন চাষিরা। পৌষ থেকে চৈত্য মাস পর্যন্ত ধানের পরিচর্যায় হাড়ভাঙা খাটুনি হয় তাদের। এখন চলছে ফসল পরিচর্যার সময়। ভোরে শিশিরভেজা পথ মাড়িয়ে কৃষকদের ছুটছেন মাঠে। সারাদিন কাজের ফাঁকে তাদের মনে কেবলই বার বার উঁকি দিয়ে যাচ্ছে আসছে বৈশাখের শেষে খেতে-খেতে সোনালী ধানের শীষের মাতোয়ারা দোল।

উপজেলার আমশো মথুরাপুর গ্রামের কৃষক কামাল মোল্লা জানান, এবার ভালোভাবে চলছে তাদের চাষাবাদ। বিলে এবার ধানের ফলন অনেক ভালো হবেও বলে তারা আশাবাদী।

চাপড়া গ্রামের আদর্শ কৃষক আতাউর রহমান ও গোকুল গ্রামের কৃষক হাফিজুর রহমান জানান, তারা এতো পরিশ্রম করে ধানের আবাদ করলেও খুব বেশি মুনাফা হয় না। তারা আরও জানান, বিলে ১ একর জমিতে ধান চাষে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকার ইউরিয়া ও টিএসপি সার দিতে হয়। এছাড়া সেচ পাম্পের মাধ্যমে ১ একর জমিতে প্রয়োজনে ৫/৭ বার পানি দিতে হয়। এজন্য কেরোসিন লাগে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ লিটার। সবকিছু মিলিয়ে একরপ্রতি ধান আবাদের শুরু থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত তাদের খরচ প্রায় ২২ হাজার টাকার মতো। কিন্তু সে তুলনায় তেমন লাভ হয় না তাদের। তবে, এবার ফলন অনেক ভালা হয়েছে। কিন্তু ধার-দেনা করে ধান চাষ করলেও ফলন ঘরে তোলার পরও তাদের ঋণের শেষ হয় না। যদি সরকারিভাবে ধানের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয় তবেই কৃষকদের সুদিন ফিরবে বলে তারা মনে করেন।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় এ মৌসুমে সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হচ্ছে। আর শিবনদীর বিলের বোরো আবাদ করা হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ২১ হেক্টর জমিতে।

এনিয়ে উপজেলা কৃষি অফিসার শফিকুল ইসলাম জানান,আমরা প্রান্তিক ভাবে মাঠে মাঠে গিয়ে কৃষকদের ফসলি জমিতে চাষাবাদ, ধানের যত্ন বিষয়ে সব ধরনের পরামর্শ দিচ্ছি। এছাড়াও কৃষকদের যে কোন সমস্যা সমাধানে আমরা সবসময় সজাগ আছি।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: