শিক্ষা ভ্রমণে কোভিড-১৯ বিড়ম্বনা (পর্ব-২)

ড. মাছুমা হাবিব

এত চেষ্টা করলাম দেশে যেতে কিন্তু আমার ভাগ্য এখানে টেনে এনেছে। শুধু মনে হতো এখানে করোনায় মারা যাবো আমার মেয়েটা জানতেও পারবেনা আমার কবর কোথায়। আমার মেয়ের জন্য দোহা থেকে কেনা সোনার আংটিটা বোধ হয় ওকে আর দিতে পারবোনা- মনে হলে বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠতো। আহা, যেদিন কিনেছিলাম সেদিন ওকে মেসেঞ্জারে ছবি পাঠিয়েছিলাম। ও না জানলেই বোধ হয় ভালো হতো। এ রকম কত কথা মনে উদয় হতো।

আমার বাবা মার জন্য ও চিন্তা হতো। ইউরোপে তখন করোনার প্রকোপ সর্বোচ্চ, আবার আমেরিকা বিশেষ করে নিউইয়র্কের অবস্থাও তখন শোচনীয়। আমি জার্মানিতে আটকা আর আমার একমাত্র ভাই তার পরিবার নিয়ে নিউইয়র্কে। আল্লাহ আমার বাবা মায়ের কি কঠিন পরীক্ষা নিয়েছেন। সব সময় উদ্বেগ আর উৎকন্ঠার মধ্যে একেকটা দিন কেটেছে। সারাদিন শুধু এম্বুলেন্স এর শব্দ শুনতাম। এম্বুলেন্স এর শব্দ শুনলে প্রচন্ড ভয় লাগতো। করোনা থেকে বাঁচার জন্য সবসময় চেষ্টা করতাম। ফেসবুকে যা দেখতাম তাই ফলো করার চেষ্টা করতাম। লোকজন শুভাকাঙ্খীরা মেসেঞ্জারে শুধু এগুলোই আমাকে পোস্ট করতো। এতো বিমর্ষ আমি আমার জীবনে কখনো থাকিনি। যে আমি সব সময় হাসি খুশি থাকতে পছন্দ করি সেই আমি হাসতে ভুলে গেছিলাম। যেদিন আমার মেয়ে মাইশা প্রথম জানতে পারলো আমি ফ্রাঙ্কফুট এয়ারপোর্ট আটকা পড়েছি, তখন থেকে প্রতিদিন নফল রোজা রাখতে শুরু করেছিল। এভাবে প্রায় দশটা রোজা করেছি।

এদিকে আমার হাইপারটেনশন এর ঔষধ শেষ। প্রেসার যে বেড়েছে সেটা বুঝতে পারছিলাম। আব্বাস ভাইকে ফোন করে ঔষুধের বিষয়টা বলাতে আমাকে ফার্মাসিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য পঙ্কজ দাদাকে পাঠিয়ে দিলেন। জার্মানির ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া প্রেসারের ঔষধ কেনা যায় না। আমি বাংলাদেশের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখালাম। ফার্মাসির মহিলা দাদার পরিচিত-উনি বললেন করোনা কালীন সময়ে বিশেষ বিবেচনায় তোমাকে ঔষধ দিলাম। আমি একটা ডিজিটাল প্রেসার মেশিনও কিনে ফেললাম। একদিন এম্বাসির ফার্স্ট সেক্রেটারি শফিউল আজমকে আমার সমস্যা গুলো বলছিলাম-উনি মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। হঠাৎ আমি বলে বসলাম আপনাকে আমি আমার সমস্যার কথা বলছি কেন-আপনিতো আর ডাক্তার না? উনি বল্লেন, জী ম্যাডাম আমি একজন ডাক্তার। সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছি। শফিউল আজম সম্পর্কে বলতে গেলে বলবো, অত্যন্ত বিনয়ী, সজ্জন, পরোপকারী, একজন মানুষ। এই ভালো মানুষ গুলো আছে বলেই আজও পৃথিবীটা এতো সুন্দর। এর মধ্যে একদিন বাংলাদেশ এম্বাসি জার্মানির এম্বাসেডর জনাব ইমতিয়াজ আহমেদ আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। উনি বলছিলেন আমরা পাশেই আছি। কিন্তু আপনাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে আপনাকে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। যাহোক এই বিজনেস হোস্টেলে ১১ দিন ছিলাম। এরপর এপ্রিলের ৪ তারিখ নতুন বিজনেস হোস্টেলে উঠলাম। এখানকার রুম গুলো অত্যাধুনিকভাবে সাজানো। এই দুই হোস্টেলের মালিক স্টেলা। তার সাথে আমার বেশ খাতির হয়ে গেল। সে সুইডেন থেকে জার্মানিতে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছে। সে যখন জানতে পারে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তখন অনেক সম্মান করে। স্টেলার একটাই সন্তান তার নাম রবিন। মিউজিক নিয়ে পড়েছে। আমার মেয়ে মাইশাও মিউজিক নিয়ে পড়ছে। রবিন পেট এনিম্যাল পছন্দ করে, মাইশাও প্রচন্ডভাবে পেট এনিম্যাল লাভার। এজন্য স্টেলা আমাকে খুব পছন্দ করতো। যাহোক স্টেলাকে অনুরোধ করে আমরা উন্নত মানের বিজনেস হোস্টেলে একই ভাড়ায় এসে উঠলাম। এখানে বলে রাখা ভালো স্টেলা আমাদের কাছে নাম মাত্র ভাড়া রাখতো। ও বলতো আমি জানি তোমরা কত বড় বিপদে পড়েছো। যখন আমি দেশে চলে আসি তখন ২ দিনের রুম ভাড়া নেয় নাই। আমাকে বলেছে আমি যেন কাউকে না বলি-এটা স্টেলার পক্ষ থেকে আমার উপহার। বিজনেস হোস্টেলের চারতলায় খোলা বারান্দার মতো অনেকটা জায়গা। মন খারাপ লাগলে এক দৌড়ে ওখানে চলে যেতাম। কখনো খোলা আকাশের নিচে ঝকঝকে রোদে বসে মোবাইল এপ্স দেখে কোরান শরীফ পড়তাম। চারপাশে বিজবাডন শহরের সুউচ্চ অট্টালিকা, পাশে বিশাল একটা গির্জা। আকাশে যখন প্লেনগুলো উড়ে যেত, মনে হতো হিচহাইকিং করি। যদি পারতাম এখান থেকে প্লেন থামিয়ে উঠে পড়তাম, তারপর চলে যেতাম আমার মেয়ের কাছে। যতক্ষন দৃষ্টিসীমায় প্লেনগুলো থাকতো আমি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ওই বারান্দায় থাকা অবস্থায় আমার মায়ের সাথে ভিডিও কল এ কথা বলতাম। আম্মা আমার মাথার উপরে জ্বলজ্বলে সূর্যটাকে দেখে বলতো, “মা এক আকাশের নিচে, এক সূর্যের নিচে তুমিও আছো আমরাও আছি” বলতে বলতে আম্মার কন্ঠ রোধ হয়ে যেত আমি বুঝতাম। আম্মা সেটা কষ্ট করে লুকানোর চেষ্টা করতো। আমার আব্বা আম্মা সব সময় হাসি মুখে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতো, বাসায় আসার পর শুনেছি ফোন রেখেই আম্মা আর নিজেকে সংবরণ করতে পারতো না, কাঁদতে থাকতো। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মতো, আমার শাশুড়ি মা প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে আমাকে ভিডিও কল করতেন। আমাকে নিয়ে উনি অনেক দুশ্চিন্তা ও দো’আ করেছেন ওই সময়ে।

আমার একমাত্র সন্তান মাইশা আমার নেদারল্যান্ডসে যাবার প্রাক্কালে প্রচুর কান্না কাটি করেছিল। আমাকে বলেছিলো-করোনা এখন সবদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। তুমি এর আগে দুইবার নেদারল্যান্ডসে গিয়েছো (আমি আসলে ২০০৪ সালে একবার এবং ২০১৭ সালে আরেকবার নেদারল্যান্ডস গিয়েছিলাম)। ওর কথা গুলো আমার মনে ধাক্কা দিয়েছিলো। শওকত ও আমার আব্বা আমার ক্যারিয়ার নিয়ে খুব বেশী সচেতন। শওকত বললো কিছু হবে না আল্লাহর নামে তুমি যাও। আব্বা যাওয়ার সময় শুধু বার বার বলছিলেন তুমি ইমেইল চেক করে দেখো।

আমার এয়ারপোর্টে ৩ দিন অবস্থানের কথা মাইশা ফেস বুকে তার অনুভূতি লিখে পোস্ট করে। এই লেখা পড়ে প্রথম সবাই জানতে পারে আমি জার্মানিতে আটকা পড়েছি। এরপর আমাদের এক ছাত্র আবুল বাশার মেরাজ, কালের কন্ঠের সাংবাদিক, মাইশার লেখাটিকে কেন্দ্র করে একটা ফিচার লিখে। এই রির্পোট পেপার এ ছাপানোর পর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমার কাছে ফোন, মেসেজ আসতে থাকে। সবাই এই রিপোর্ট টি এতো বেশি বেশি ফেসবুকে শেয়ার করেছে – যেটা অকল্পনীয়। বেঁচে থেকে দেখার সুযোগ হলো পৃথিবীতে কত মানুষ আমাকে ভালবাসে। অনেকেই ফোন করে আমাকে উপদেশ দিয়েছেন, সাহস জুগিয়েছেন। আমি দুঃখিত, ওই সময় অনেকের ফোন ধরতে পারি নাই। প্রতিটি মুহূর্ত কাটতো করোনা আতঙ্কে। ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ সবসময় কমন প্লেসে তখন আমাকে চলতে হতো। নিজের রুমটুকু বাদে সব জায়গায় করোনার জীবাণু সংক্রমিত হওয়ার ভয় ছিল। হাত ধুতে ধুতে আমার হাত গুলো বুড়ো মানুষের চামড়ার মত হয়ে গিয়েছিলো।

জার্মানীতে থাকা আমাদের ছাত্র খাইরুল বাসার আমার হেলথ ইন্সুরেন্স করে দেয়। আমার প্রাক্তন কলিগ প্রফেসর আশরাফ সব সময় ফোন করে খোঁজ নিয়েছে। ওর মাধ্যমে জার্মানিতে ইব্রাহিম ভাইয়ের সাথে আমার যোগাযোগ হয়। ইব্রাহিম ভাই আমাকে বিভিন্ন ভাবে সহায়তা করেছেন- যা লিখে শেষ করা সম্ভব নয়। যেদিন আমি বাংলাদেশে চলি আসি সেদিন ও মাস্ক এবং হ্যান্ড গ্লাভস দিয়ে গেলেন। যেভাবে ছোট বোনরা কোথাও গেল বড় ভাইরা সব ধরণের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন। এখানে আর একজন বাংলাদেশী সোলেমান এর সাথে আমাদের পরিচয় হয়। উনি বিভিন্নভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। আমি সোলেমানকে ডাকতাম বাদশা সোলেমান বলে। মানুষের মন কত বড় হলে দিনের পর দিন মানুষ এভাবে মানুষের জন্য করতে পারে। এছাড়া আমার বন্ধু লিটনের কাজিন শামীম ভাই, প্রফেসর হাসিনা বীথির পরিচিত জিয়া ভাই আমাকে দেখতে এসেছিলেন। এই দুর্যোগের সময়, লক ডাউন এর সময় করোনার ভয়ে যখন মানুষ অস্থির, এর মধ্যে এতো কিছু আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। এভাবেই চলছিল আমার দিন রাত্রি। তাহাজ্জুদের নামাজ নিয়মিত পড়তাম, ফজরের নামাজ পড়ে, দো’আ দরূদ পড়ে আবার একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতাম। প্রতিদিনই ৭ টার মধ্যে ঘুম ভেঙ্গে যেত। তবে করোনা থেকে বাঁচতে আমি যা যা করতাম। প্রথমত ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলে বড় বড় শ্বাস নিতাম নির্মল বাতাসে। তারপর কালোজিরা চিবিয়ে খেতাম। এরপর আলমন্ড (কাঠবাদাম) ৩/৪টা, ২টা খেজুর খেতাম। তারপর দুপুর ১২/১টার দিকে ডাইনিং এ যেতাম। সেখানে প্রথম যে কাজটা করতাম একটা লেবু পুরোটা রস করে গরম পানি মধু দিয়ে এক মগ খেতাম। এরপর রসুন, আদা, গোলমরিচ, লবন, লেবু, আপেল সাইডার ভিনেগার, অলিভ অয়েল সব একসাথে একটা সসপ্যানে পানি দিয়ে সিদ্ধ করতাম। এরপর কমপক্ষে ১০ মিনিট নাক মুখ দিয়ে ভাপ নিতাম। নিয়মিত এটা ২ বার করতাম সকালে এবং রাতে।

দেখতে দেখতে রমজান মাস চলে এলো। আমরা জার্মানিতে রোজা করা শুরু করলাম। এপ্রিলের ২৮ তারিখ সকালটা অন্য সব দিনের মতোই ছিল। জার্মান বাংলাদেশ এম্বেসির কনস্যুলার তুহিন রসুল ফোন করে বললেন, মে মাসের ১ তারিখে বিকাল ৩ টায় কাতার এয়ারওয়েজের চাটার্ড ফ্লাইটে আপনাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমি আমার হাসব্যান্ড শওকতকে প্রথম ফোন করলাম। আমি জানি আমার জন্য দিনের পর দিন সে কি পরিমান মানষিক যন্ত্রনা ভোগ করেছে। তুহিন রসুল এর সাথে কথা বললে আমার মনটা এমনিই ভালো হয়ে যেত। আমি নিঃসংকোচে উনাকে সব বলতে পারতাম। উনার যে সে কি আন্তরিকতা- আমাকে যদি দেশে পাঠাতে পারেন। আমি সারাজীবন এম্বেসীর সবার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো। এর মধ্যে আমাদের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আমাকে ফোন করে বললেন যে স্পেশাল ফ্লাইট এর ব্যবস্থা হয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপ এর মহাপরিচালক জনাব আন্দালিব ইলিয়াস ভিসি স্যার কে ফোন করে জানিয়েছেন। ভিসি স্যার এর আগে উনাকে ইমেইল করেছিলেন যাতে আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। ভিসি স্যার আমার বিষয়ে ফরেন মিনিস্ট্রিতে সবসময় যোগাযোগ করেছেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক এর এমন দায়িত্বশীল ভূমিকা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

করোনার লক্ষন নাই এই মর্মে মেডিকেল সার্টিফিকেটের জন্য ৩০ তারিখ সকালে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কিন্তু সকাল থেকে আমার বেশ জ্বর। এমনি সর্দি, কাশি, গলাব্যথা কিছু ছিলোনা। যাহোক, আমি আমার এই জ্বরের কথা কাউকে বলতেও পারছিলাম না। কারণ এই মহামারীর সময় জ্বর মানেই করোনা। আমি নিঃসংকোচে এই জ্বরের কথা ফাস্ট সেক্রেটারি ডা. শফিউল আজম কে ফোন করে বললাম। উনি বললেন প্যারাসিটামল খেয়ে নেন। কারণ জ্বর থাকলে ডাক্তার আপনাকে সার্টিফিকেট দিবে না। বাধ্য হয়ে ২টা খেজুর খেয়ে, রোজা ভেঙ্গে ১টা প্যারাসিটামল খেয়ে তারপর ডাক্তারের কাছে গেলাম। এদিকে শওকত তার ক্যাডেট কলেজে পড়াকালীন বন্ধু বাংলাদেশ বিমানের পাইলট শামীম ভাইকে বললেন ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে আমার টিকিট কেটে দেয়ার জন্য। জার্মানি থেকে আমরা মোট ৪ জন বাংলাদেশে আসার জন্য টিকেট কেটেছিলাম। আমরা বিজবাডন থেকে ৩ জন আর ড্রেসডেন থেকে আমাদের ওখানে আসলেন রাজা ভাই। দেলোয়ার হোসেন রাজা ভাই গান বাংলা (এই) চ্যানেল এর চেয়ারম্যান। আব্বাস ভাই ৩০ তারিখে গ্রান্ড ইফতারের আয়োজন করেন। জার্মানিতে অবস্থানকালীন সময়ে আব্বাস ভাইকে অনেক বিরক্ত করেছি। এই ভালো মানুষ গুলোর কাছে আমি চির ঋনী।

এবার আসলো সেই কাঙ্খিত দিন যে দিনটির জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি। আব্বাস ভাই ৩টা গাড়ি নিয়ে এসেছেন আমাদের এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেয়ার জন্য। জার্মানিতে করোনার কারণে কোনো গাড়িতে ৩ জনের বেশি বসার নিয়ম নাই। তখনও এয়ারপোর্ট একদম ফাঁকা। হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র যাত্রী। আমরা প্লেনে উঠলাম। মনে হচ্ছিলো প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে কোথাও যাচিছ। ফ্রাঙ্কফুট থেকে দোহা পর্যন্ত একাই বিশাল স্পেস এ বসে আসলাম। এর মধ্যে একজন এয়ার ক্রু এলেন আমার কাছে। তার নাম সামেন, সে বাংলাদেশী। সেও দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু ফিরতে পারছে না। প্লেন থেকে নামার সময় সব এয়ার হোস্টেজরা এমন ভাবে বিদায় দিলো যা আজীবন মনে থাকবে। যাহোক আমরা দোহা এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। এখানে আমাদের ১৬ ঘন্টা যাত্রা বিরতি ছিলো। করোনা কালীন সময়ে কোনো হোটেল আমাদের দেয়া হয় নাই। আমরা লাউঞ্জে অবস্থান করি। পরদিন দোহা সময় ৩টায় আবার আমাদের ফ্লাইট। এবার আমরা সর্বসাকুুল্যে ১০জন যাত্রী। এর মধ্যে হঠাৎ প্লেনে বাম্পিং শুরু হয়। তাহলে কি আরো একটা ইতিহাস গড়তে যাচ্ছি প্লেন ক্র্যাশে মৃত্যুর- আমার মেয়ের সাথে আর দেখা হবে না। এসব এলোমেলো ভাবনাগুলো মনে আসছিলো। বাম্পিং আরো বাড়তে শুরু করলে পাইলট ঘোষনা দিয়ে এয়ার ক্রুদেরও সিট বেল্ট বেঁধে বসতে বললেন। তখন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলাম। আমাদের প্লেন ঢাকা ল্যান্ড করার কথা রাত ১১টা বেজে ৫ মিনিটে। কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাইলট ঘোষনা দিলেন এক ঘন্টা আগে অর্থাৎ আমরা ১০টা ৫ মিনিটে ঢাকা ল্যান্ড করেছি। যাহোক, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত একটা ফর্ম পূরণ করে স্ক্যানারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এরপর মেডিকেল বোর্ডের সামনে গেলাম। মেডিকেল সার্টিফিকেট দেখাতে বললে সেটা দেখিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার ইমিগ্রেশনে এসে দাঁড়ালাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে আমি এয়ারপোর্ট থেকে ময়মনসিংহে আসি।

স্বপ্নের মতো করে দেশে ফিরে আসলাম। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যেদিন দেশে ফিরে আসলাম সেদিন ছিলো মে মাসের ২ তারিখ। আমার একমাত্র সন্তানের জন্মদিন অর্থাৎ আমার মাতৃত্ব দিবস, যে দিন আমি প্রথম মা হয়েছিলাম। আমার ফিরে আসা আমার মেয়ের জীবনের সেরা জন্মদিন হয়ে থাকলো। আমার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের দো’আ এবং শুভকামনায় আমার বাংলাদেশে আসা সম্ভব হয়েছে। যে সময় ইউরোপে সর্বোচ্চ করোনার সংক্রমণ এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটছিলো সে সময় কালে এয়ারর্পোটে ৪ দিন (আমস্টারডাম এর ইশ্চিফুল এয়ারপোর্টে ১ দিন এবং ফ্রাঙ্কফুট এয়ারপোর্টে ৩ দিন) এবং জার্মানিতে প্রায় ৪০ দিন আমি যে কোভিড-১৯ মুক্ত থাকতে পেরেছি তা মহান আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানি।

প্রফেসর ড. মাছুমা হাবিব
গ্রাজুয়েট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
sm1997m@yayhoo.co.uk

আরও পড়ুন:  শিক্ষা ভ্রমণে কোভিড-১৯ বিড়ম্বনা (পর্ব-১)

 

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3