ঢাকা থেকে বাসা ফিরছে অসহায় মানুষ

নিউজ ডেস্কঃ

২০০৭ সালে ঢাকায় আসেন কালাম মিয়া। ১৩ বছরের এই সময়ে কখনও ব্যক্তিগত গাড়িচালক, কখনও মাইক্রো চালানো এবং সর্বশেষ উবার চালিয়ে জীবন নির্বাহ করেছেন। গত এপ্রিলের এক তারিখ থেকে কাজ নেই। কিন্তু খরচ তো থেমে থাকে না। আয় না থাকা এই মানুষটি গত দুই মাসে জমানো সামান্য কিছু টাকা আর চেয়ে-চিন্তে চলে জুনের ১৫ তারিখ সিদ্ধান্ত নেন গ্রামে ফিরে যাবেন। যদি ঢাকার পরিস্থিতি কোনোদিন ভালো হয়, হয়তো আবারও ফিরে আসবেন।
শুধু কালাম মিয়া নন শহরের নিত্য ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে বাধ্য হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন হাজারও কর্মহীন মানুষ। তারা ফিরছেন একেবারে নিঃস্ব হয়ে। প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা যায়, মালপত্র ভর্তি বাহনে করে ঢাকা ছাড়ছে মানুষ। তাদের মধ্যে কেউ দিনমজুর, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউ গার্মেন্টস শ্রমিক, ছাত্র-প্রাইভেট শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষ।

একদিকে যেমন সব ছেড়ে মানুষ গ্রামে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে আরেকদিকে বাসা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ার বাসা খুঁজছেন অনেকে। বেসরকারি সংস্থায় অফিস সহকারীর কাজে কর্মরত গাইবান্ধার হাসান থাকতেন ছোট একটা ফ্ল্যাটবাড়িতে বাড়ি। ভাড়া ১২ হাজার। বউ কাজ করতেন আয়া হিসেবে এক বাসায়, ৮ ঘণ্টা বাচ্চা রাখার কাজ। দুজনে মিলে আয়-রোজগার ভালোই ছিল। করোনা শুরু হওয়ার পরে বউয়ের কাজ চলে গেলে বাড়ি ভাড়াটাই হয়ে ওঠে গলার কাঁটা। গত মাসে বাড়ি খুঁজে ৩শ’ ফিট থেকে ভেতরের দিকে একটা ছোট্ট টিন-শেডে উঠে পড়েছেন এই মাসের শুরুতে।

আয় নেই, ভাড়া বাকি

পিকআপে মালপত্র নিয়ে বসে আছেন সাহেরা ও তার মা আয়নুরা বেগম। একটি খাট, ছোট টেবিল, টিভি, বেডিং, রান্নার জিনিস বস্তাবন্দি। মিরপুরের পাইকপাড়ায় টিন-শেডে দুই রুমে থাকতেন। স্বামী গুলিস্তানে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। কাজ থেকে বাদ পড়েছেন মার্চের ২৬ তারিখ। সাধারণ ছুটি শেষ হলে যদি আবার সব স্বাভাবিক হয় এই আশায় ঢাকায় ছিলেন। কিন্তু ঢাকার বেশিরভাগ রেস্টুরেন্ট জুনের শুরুতে খোলা হলেও, ছাঁটাই করা হয় তাকে। ত্রাণ নিয়ে এই কয় মাস খাওয়ার সংস্থান হলেও বাড়ি ভাড়া, বিভিন্ন বিল দিতে যে নগদ টাকা লাগে তা হাতে নেই। স্ত্রী সন্তান ও শাশুড়িকে গ্রামে রেখে এসে কোনও মেসে উঠে কাজের সন্ধান করার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। মালিবাগের একটি টিন-শেডের মালিক ফয়সাল মামুন বলেন, আমার এদিকটায় গার্মেন্টস শ্রমিক বেশি থাকায় কখনও এই দশটা ঘর খালি থাকেনি। প্রথমে মার্চে ঘর ছেড়ে চলে গেলো শ্রমিকরা। এপ্রিল মে ফাঁকা থাকলো। মে মাসের শেষে ফেরত আসলো কিন্তু এখন আবার নোটিশ দিয়েছে জুলাই থেকে ছেড়ে দেওয়ার। কাজ নেই, ছাঁটাই করা হয়েছে। ফলে আবার টু-লেট ঝুলিয়েছি।

দুই মাসে কিস্তি পরিশোধে ফুরালো শেষ সম্বল

এক বাসায় চারজন রোজগারের মানুষ। মা বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। মেয়ে গার্মেন্টসে, মেয়ের জামাই ব্যক্তিগত গাড়িচালক, ছেলে ভ্যানে সবজি বিক্রেতা। মেয়ের ঘরে দুই কন্যা, ছেলের এক শিশু। চারজনের আয় ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। এখন সবাই বেকার, সবজি বিক্রেতা ছেলের হঠাৎ টিবি ধরা পড়ায় তার কাজও বন্ধ। সচ্ছল একটি পরিবারে এখন একবেলা খাবার জোগাড় করাও কষ্টকর হয়ে গেছে। ৯ হাজার টাকা দিয়ে যে বাসায় ভাড়া থাকতেন সেখানে বাকি পড়েছে এই মাসে প্রথম। ঘরের ফ্রিজ কিনেছিলেন মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে, বাকি পড়েছে সেই কিস্তির টাকা। কোনোমতে বাড়ি ভাড়ার টাকা চেয়ে নিয়ে শোধ করেছেন। মুদির দোকানের ঋণ, কিস্তির বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে লুকিয়ে ফিরে গেছেন গ্রামে।

একদম খালি হাতে গ্রামে ফিরেই বা কী করবেন প্রশ্নে প্রাইভেট গাড়িচালক দিদারুল বলেন, গ্রামের দিকে কিছু একটা করে খাওয়া যাবে। আত্মীয়রা প্রথম কয়দিন জায়গা দিলে ব্যবস্থা একটা হবে। এই শহরে কখনও খাবারের জন্য হাত পাততে হবে ভাবিনি, করোনা আমাদের সেটাও করিয়েছে। সন্তানের ক্ষুধার্ত চেহারা দেখতে কার ভালো লাগে। তার ওপর আছে মাস শেষে বাড়ি ভাড়ার তাগাদা।

ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহরানে সুলতান বাহার বলেন, এমন হবে সেটা শুরুতেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল। এখন পর্যন্ত আমাদের হিসেবে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ কেবল ভাড়া দিতে না পেরে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আমরা শুরু থেকেই বলছিলাম, তিন মাসের ভাড়া মওকুফ, বিল মওকুফের ব্যবস্থা করা হোক। সরকার কানে তোলেনি। এমন খবরও আমাদের পরিষদে এসেছে যে, কেউ কেউ যাওয়ার সময় আসবাব বিক্রি করে ভাড়া পরিশোধ করে গেছে।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: