করোনা প্রতিরোধে স্কুল শিক্ষার্থীদের বিনোদনমূলক স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রয়োজন

ড. মোঃ সহিদুজ্জামান

কোভিড -১৯ ও অন্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে স্কুল শিক্ষার্থীদের বিনোদনমূলক স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রদান প্রয়োজন। শিশুদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে  অদ্যবধি যথেষ্ট  বিতর্ক রয়েছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে কভিড-১৯ প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের কম হয়। হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা কম বা লক্ষণবিহীন হয়ে থাকে। আবার লক্ষণহীন শিশুদের থেকে তা অন্যদের সংক্রমিত করতে পারে। তাই শিশুদের ক্ষেত্রে গুরুত্ব কম দেওয়ার কোন অবকাশ নেই। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা হলে এ ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে বলা হচ্ছে। সম্প্রতি এ রকম একটি  প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে “ইনফেক্শাস ডিজিজ অব পোভার্টি”  জার্নালে। সেখানে বলা হচ্ছে, শিশুরা যদিও অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ  তথাপিও তাদের সংস্পর্শে এসে অভিভাবক বা বয়স্করা আক্রান্ত হতে পারেন এবং এসব বয়স্ক ব্যক্তিরা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যায় ভুগে থাকলে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন।

করোনা প্রতিরোধে বিশ্বে যত ধরণের তথ্য ও উপাত্ত সরবরাহ করা হচ্ছে তার অধিকাংশই সাধারণ বা প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য। শিশুদের জন্য বিশেষ কোন স্বাস্থ্য শিক্ষামূলক তথ্য উপাত্ত প্রদান করা হচ্ছে না যেটি গুরুত্বসহকারে ভাবা দরকার। শিশুরা মা-বাবাদের অনুকরণ করতে পারে কিন্তু স্বাস্থ্যবিধির সত্যিকার অর্থ বুঝতে না পারায় স্বাস্থ্যবিধি বা সামাজিক প্রোটোকলগুলি তাদের জন্য বিভ্রান্তি, ভয় এবং ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই শিশুদেরর জন্য অংশগ্রহণমূলক ও আকর্ষণীয় স্বাস্থ্যকর এবং সামাজিক দূরত্ব  শিক্ষার  প্রচারে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

স্কুল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে বিনোদনমূলক স্বাস্থ্য শিক্ষা করোনাভাইরাস প্রতিরোধে যেমন অত্যন্ত কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারে তেমনি অন্যান্য সংক্রমক রোগ থেকেও সুরক্ষা দিতে পারে। অনেক সংক্রামক রোগ আছে যেগুলো মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়, আবার অনেক রোগ আছে যেগুলো পশুপাখি থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে মানুষে যেসব রোগবালাই হয় তার প্রায় ৭০ ভাগ পশুপাখি থেকে আসে। সুতরাং গবাদি পশুপাখির সাথে মেলামেশা, সেবা ও ব্যবস্থাপনা এবং ভক্ষণের ক্ষেত্রে সংক্রমনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যদিও পশুপাখি থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমনের কোন বৈজ্ঞানিক  প্রমান এখনও মিলেনি, তবে মানুষ থেকে দু-চারটি প্রাণিতে সংক্রমনের ঘটনা ঘটেছে।

পশুপাখি থেকে রোগবালাই বিভিন্নভাবে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে। প্রথমত-পশুপাখির মল-মুত্র, লালা, রক্ত, নাড়ি-ভুড়ি বা আক্রান্ত প্রাণির সংস্পর্শে এলে অথবা তাদের কামড় ও আঁচড়ে সরাসরি মানুষ বিভিন্ন সংক্রামক রোগবালাই দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। দ্বিতীয়ত- আক্রান্ত প্রাাণির বাসস্থান অথবা তাদের সংস্পর্শে থাকা কোন বস্তুু (খাবারের পাত্র, ব্যবহৃত খাদ্য, মাটি ইত্যাদি)  থেকেও মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। তৃতীয়ত- মধ্যবর্তী কোন পোষক যেমন পোকা-মাকড়ের (মশা, মাছি, আঠালি) কামড়ে এবং চতুর্থত- কলুষিত বা দুষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে বিভিন্ন রোগবালাই মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে।

ডাইরিয়া, আমাশয়, জ্বর, সর্দি, কাশি সহ অনেক রোগের জীবানু পশুপাখি থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। এমনকি কিছু জীবানু আছে যা গর্ভবতী মা বোনদের গর্ভপাত ঘটাতে পারে। এছাড়া বাচ্চাদের মস্তিস্কের ক্ষতি করতে পারে। শিশু, বয়স্ক, কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলারা এসব সংক্রামক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। অথচ সামান্য একটু সচেতন হলেই এসব রোগ জীবানু থেকে সহজেই রেহাই পাওয়া সম্ভব।

নবেল করোনা ভাইরাসসহ সংক্রমন যোগ্য বিভিন্ন রোগবালাই সম্পর্কে স্কুলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, স্টাফ ও অভিভাকেদের সাধারণ ধারণা প্রদান করা প্রয়োজন। যদিও কিছু অনুষ্ঠান বিভিন্ন  প্রচার মাধ্যমে বিশেষ করে টেলিভিশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধমে প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু শিশুদের এসব মাধ্যমে দেখার  সুযোগ ও আগ্রহ দুটোই কম থাকে। স্কুলে যদি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের উপযোগী করে বিভিন্ন ভিডিও চিত্র, কার্টুন বা ডকুমেন্টারি দেখানো যায় তাহলে স্বাস্থ্যবিধির বিষয়গুলো বুঝতে ও অনুশীলনে সহজ হবে।

উন্নত বিশ্বে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিশুদের উপযোগী স্বাস্থ্য সচেতনমূলক শিক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে মেডিকেল ও ভেটেরিনারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সংক্রমিত রোগ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, চিত্র, কার্টুন ও লিফলেট এর মাধ্যমে সহজ ও সাবলীলভাবে তারা এসব রোগের জীবনচক্র, ক্ষতিকারক দিক এবং সংক্রমন ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকে। এছাড়া ব্যবহারিক শিক্ষার মাধ্যমে অনুশীলনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

করোনাসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগের জীবনচক্র, প্রকৃতি ও পরিবেশে এদের অবস্থান ও সংক্রমনের উপায় সহজভাবে ভিডিওচিত্র, কার্টুন বা বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে বোঝানো যেতে পারে। যেমন- শিশুরা পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে কিভাবে জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। পোষা প্রাাণি- কুকুর, বিড়াল এর সংস্পর্শে এসে কিভাবে ক্ষতিকারক জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। মশা মাছি কিভাবে জীবানু ছড়ায়। শিশু বা অন্যান্যরা মাটি থেকে কৃমি দ্বারা কিভাবে আক্রান্ত হতে পারে। মাটি ও পানি কিভাবে এসব জীবানু দ্বারা দুষিত হয় এবং এসব দুষিত মাটি বা পানি থেকে কিভাবে জীবানু মানুষে সংক্রমিত হয়- এসব বিষয়ে বিনোদনমূলক শিক্ষা প্রদান করা যেতে পারে। এছাড়া ঋতু পরিবর্তনে যে সব রোগবালাইয়ের ঝুঁকি থাকে সেগুলো সম্পর্কে ধারণা ও সতর্কতা প্রদান করা যেতে পারে। জ্বর বা কোন সংক্রমক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে জানানো, আক্রান্ত অবস্থায় অন্যের সঙ্গে হাত মেলানো, কোলাকোলি বা সংস্পর্শে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত থাকার শিক্ষা প্রদান করতে হবে। হাঁচি দেওয়ার সময় অন্যদের কাছ থেকে দুরে সরে যাওয়া, মুখে হাত বা অন্য কিছু দেওয়ার অভ্যাস করাতে হবে। এছাড়া শারীরিক কিছু ব্যায়ামও নিয়মিত শেখানো দরকার। শুধু কোভিড-১৯ নয় যে কোন ধরণের সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে বছরজুড়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান করা  প্রয়োজন। প্রয়োজন পুরুস্কার ও সার্টিফিকেট দিয়ে তাদের উৎসাহিত করা। শিশুরা এসব শিখে অন্যকে শেখাতে পারবে এবং পরিবার ও সমাজ উপকৃত হবে। প্রয়োজনে অভিভাবকদের জন্য স্কুলে সেমিনার ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে যাতে এসব অভিভাবক বাসায় শিশুদের স্বাস্থ্যবিধির নিয়ম মানাতে ও বোঝাতে সহায়তা করতে পারে।

করোনা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও শিশুদের অমানবিক চাপ কমানোর জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। সুযোগ করে দিয়েছে স্বাস্থ্যসুরক্ষায় সচেতন হবার। শিশুদের মানসিক চাপ কমাতে পুঁথিগত বিদ্যা কমিয়ে বিনোদনমূলক শিক্ষা ও সংস্কৃতিক কর্মকান্ড বাড়ানো  প্রয়োজন। প্রয়োজন স্কুল সময়কে কমিয়ে আনা। প্রয়োজনে দুই শিফটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। টিফিন সময় বাদ দেয়া যেতে পারে। সুযোগ থাকলে বদ্ধ ঘরে পাঠদান না করে খোলা মাঠে করা যেতে পারে সাময়িকভাবে। স্কুলে পাঠদান কমিয়ে হোম ওয়ার্ক বাড়ানো যেতে পারে।

শিশুদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পোশাক আশাক পড়িয়ে স্কুলে পাঠানো এবং স্কুল থেকে ফেরার পর শিশুদের জামা কাপড়, জুতা মোজা আলাদা জায়গায় রেখে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা প্রয়োজন।

প্রতিটি স্কুলে স্বল্প পরিসরে হলেও স্বাস্থ্য সেবার জন্য একটি কক্ষ থাকা প্রয়োজন যেখানে থাকবে একজন প্রশিক্ষিত নার্স।  প্রত্যেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও স্টাফদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ, নিয়মিত টিকাদান এবং কৃমিনাশক খাওয়ানোর কর্মসূচী চালু রাখা প্রয়োজন। প্রয়োজন তথ্য-উপাত্তসহ মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রাখা।

শিক্ষার বৈষম্য ও বেগ কমাতে অভিভাবক ও শিশুদের অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আনতে হবে। নৈতিক, সামাজিক ও চারিত্রিক শিক্ষার দিকে জোড় দিতে হবে। তাহলে শিশুদের মানসিক বিকাশের পাশাপাশি নৈতিক ভিত্তির মাধ্যমেও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সাধিত হবে। মনে রাখতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে শুধু কোভিড -১৯ নয় যে কোন সংক্রামক রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

গবেষক ও অধ্যাপক
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3