করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে আমাদের করণীয়

Shahiduzzaman

ড. মোঃ সহিদুজ্জামান

একটি ভাইরাস যখন বংশ বৃদ্ধির লক্ষ্যে তার প্রতিলিপি তৈরি করে, তখন মাঝে মাঝে এর জিনের উপাদানে কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি ঘটে। এছাড়া অনুলিতি তৈরির সময় বাধাগ্রস্থ হলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ফাঁকি দিতে ভাইরাস নিজেকে পরিবর্তন করে থাকে। একেই আমরা বলি মিউটেশন এবং এভাবেই নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব ঘটে। ভাইরাস জগতে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। ভাইরাসের এমন চরিত্রের কারনে বলা যায় উহানে শুরুর সময়ের যে করোনাভাইরাস আর এখনকার সারা পৃথিবীর করোনাভাইরাস এক নয়। প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে সার্স কোভি-২ নামক এই করোনা ভাইরাসটি।

ভাইরাসের জিনগত যে পরিবর্তন হয় তা ভাইরাসটির জিনের একটি জায়গায় বা একাধিক জায়গায় হতে পারে। একইসময়ে একবার হতে পারে আবার একাধিকবারও হতে পারে। দুবার হলে বলছি ’ডাবল মিউটেন্ট’ এবং তিনবার হলে ’ট্রিপল মিউটেন্ট’। তবে গবেষকরা বলছেন কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী এই করোনা ভাইরাসটির মিউটেশন ইনফ্লুয়েজ্ঞা (ফ্লু) ভাইরাসের তুলনায় ৪ গুন কম হয়ে থাকে। অর্থ্যাৎ মাসে দু-একটি মিউটেশন হতে পারে। মিউটেশনের ফলে বা জিনগত পরিবর্তনের ফলে ভাইরাসের যে বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন হচ্ছে তাতে তারা দূর্বল হতে পারে আবার সবল ও আক্রমানত্বক হয়েও উঠতে পারে। পরিবর্তন হতে পারে ভাইরাসটির ‘সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষমতা এবং রোগাক্রান্ত করার ক্ষমতা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাইরাসের পরিবর্তীত নতুন রূপগুলো দূর্বল হয়ে থাকে। হঠাৎ দু একটি যে আক্রমানত্বক রূপ ধারণ করে সেগুলোর সংক্রামক এবং রোগ উৎপাদন ক্ষমতা বেশী থাকায় পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। আবার নতুন সুষ্ট এই আক্রমানত্বক ভ্যারিয়েন্টগুলা যে সবসময় শক্তিশালী থাকবে তাও নয়। এটিও সংক্রমিত হতে হতে পরিবর্তন হয়ে দূর্বল হয়ে যেতে পারে।

করোনাভাইরাস যত সংক্রমিত হবে বা পোষকদেহ যতবার পরিবর্তন করার সুযোগ পাবে ততই তার মিউটেশন বা জিনগত পরিবর্তন হবে। এভাবে পরিবর্তন হতে হতে এমন এক রূপ ধারণ করবে যা স্থায়ী হয়ে বিচরণ করতে থাকবে। এমন স্থায়ী রূপকে ভ্যারিয়েন্ট বা নতুন স্ট্রেইন (জাত) বলা হয়ে থাকে। পরিবর্তীত এই রূপগুলো কখনও কখনও বেশী সংক্রামক ও আক্রমানত্বক হয়ে থাকে যেমন যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.১.৭), দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৩৫১), ব্রাজিলিয়ান ভ্যারিয়েন্ট (পি.১), ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যারিয়েন্ট (বি.১.৪২৭ এবং বি.১.৪২৯), বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.৬১৮) এবং সর্বশেষ ভারতের নতুন ভ্যারিয়েন্ট (বি ১.৬১৭)। এগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শুধু যুক্তরাজ্য ও আফ্রিকার স্ট্রেইন পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে।

করোনা থেকে বেঁচে থাকতে হলে কার্যকরী ঔষধ বের না হওয়া পর্যন্ত শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়েই বেঁছে থাকতে হবে। এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দু’ভাবে তৈরি হতে পারে। একটি প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থ্যাৎ জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে সেরে উঠলে এবং কার্যকরী টিকা বা ভ্যাক্সিন এর মাধ্যমে।

রোগ প্রতিরাধ ক্ষমতার বিষয়টি জঠিল। প্রাকৃতিক সংক্রমণের ফলে শরীরে যে অ্যান্টিবডি এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তার ব্যাপ্তি ও সক্ষমতা অনেকাংশে বেশী কারণ এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভাইরাসের অনেকগুলি অংশকে লক্ষ্য করে তৈরি হয় । কিন্তু করোনার যেসব টিকা এ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়েছে সেগুলো থেকে যে এন্টিবডি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি হচ্ছে তা মূলত ভাইরাসের একটি অংশ (স্পাইক প্রোটিন) কে লক্ষ্য করে। ফলে নতুন ভাইরাস বা মিউট্যান্ট এর ক্ষেত্রে টিকা গ্রহণে তৈরি এন্টিবডি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ নাও করতে পারে। কারণ এসব ভ্যারিয়েন্ট শুধু টিকা দ্বারা তৈরি শরীরের সংকীর্ণ প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে বাঁচতে পারে। যদিও বিষটি নিয়ে আরও গবেষণা হচ্ছে। তবে প্রাকৃতিক সংক্রমণের ফলে শরীরে যে অ্যান্টিবডি এবং ব্যাপক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় তা দিয়ে নতুন নতুন অনেক ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন এর আক্রমন থেকে শতভাগ না হলে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। তাই টিকা নিতে কোন সমস্যা নেই।

তবে ভাইরাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে টিকা উৎপাদনও পরিবর্তন করতে হবে যা নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টকে প্রতিরোধ করতে পারবে। আর এজন্য সারা বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নমুনা থেকে করোনার স¤পূর্ন জিন সিকোয়েন্স বা জিনগত বৈশিষ্ট নিরূপন করা দরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিনিয়ত এই উম্মোচিত জিনগুলোর তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করছে। এক্ষেত্রে যে দেশ যতবেশী এগিয়ে থাকবে সেদেশ তত দ্রুত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে। তাই অন্যের তথ্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের দেশের তথ্য উম্মোচন ও হালনাগাদ করা জরুরী। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সম্ভাব্য রোগী খুঁজে বের করা, নমুনা সংগ্রহ করে সেখান থেকে জিন সিকোয়েন্স করার কাজটি আমাদের প্রতিনিয়ত করতে হবে। করোনার ধরণ ও গতি প্রকৃতি মনিটরিং করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে হঠাৎ করে অন্যদেশগুলোর মত ভয়াবহ অবস্থা যে হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দেশ ও জাতি ভেদে তারতম্য হতে পারে। আবার মানুষের খাদ্যাভাস, শরীরের গঠন, বয়স, শারীরিক অবস্থা এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রভাবভেদে ও এই তারতম্য হতে পারে। যেমন একটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও একজন বয়স্কের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক নয়। স্বাভাবিক সুস্থ্য মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং রোগাক্রান্ত ব্যক্তির (যেমন, কিডনী রোগী, এইডস রোগী) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এক নয়। খাদ্যাভাস মানুষকে যেমন সুস্থ্য ও স্বাভাবিক করে গড়ে তোলে তেমনি অসুস্থ বা অস্বাভাবিক করে তোলে। খাবার বা অভ্যাসের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পেতে পারে তেমনি খাদ্য বা অভ্যাসের কারণেও তা হ্রাস পেতে পারে। তবে খারাপ অভ্যাস শরীরের জন্য কখনই ভাল নয়।

আবার এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার বরাই করে লাভ নেই কারণ প্রকৃতি ও পরিবেশের পরিবর্তনে বা শারীরিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে এবং সময়ের প্রেক্ষিতে এই প্রতিরোধ ক্ষমতার পরিবর্তন হতে পারে, ভেঙ্গে যেতে পারে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এছাড়া রোগের ধরণ বা জীবানুর পরিবর্তনের ফলে এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজে নাও আসতে পারে। তাই বেঁচে থাকতে হলে আমাদের প্রতিনিয়ত সাবধান থাকতে হবে। মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। চালিয়ে যেতে হবে গবেষণা। বাড়াতে হবে নিজেদের সক্ষমতা।

মৌসুমভেদে বা ঋতুভেদে যে সব ফলমূল, শাকসব্জী বা ফসল উৎপাদিত হয় সেগুলো কিছু কিছু করে হলেও খাওয়ার অভ্যাস করা প্রয়োজন। কারণ সৃষ্টিকর্তা ঋতুভেদে যেসব রোগ বালাই সৃষ্টি করেছেন এসব রোগ বালাইয়ের নিয়ন্ত্রন বা প্রতিরোধে প্রকৃতিতে তার উপাদানও তৈরি করে রেখেছেন।

করোনার এই থাবা থেকে মুক্তি পেতে গেলে সংক্রমনকে প্রতিহত করার কোন বিকল্প নেই। সংক্রমন নিয়ন্ত্রণ হলে নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট বা জাত সহজে তৈরি হবে না। কারণ ভাইরাসটি যত কম সংক্রমিত হবে তত কম মিউটেশন হবে ফলে ভ্যারিয়েন্ট বা নতুন জাত কম তৈরি হবে। আবার সংক্রমন কমানোর প্রধান উপায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বিশেষ করে সারা বছর জুড়ে মাস্ক পরিধান করার অভ্যাস তৈরি করা। জনগনকে সচেতন করতে এবং মাস্ক পরিধানকে বাধ্যতামূলক করতে প্রয়োজনে বছরব্যাপী অভিযান ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু রাখা যেতে পারে। প্রয়োজনে মাস্ককে পোশাকের অভিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বা ফ্যাশন ডিজাইন হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতি চালু করা যেতে পারে।

অন্য দেশ থেতে যাতে কোন ভ্যারিয়েন্ট বা স্ট্রেইন দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেক্ষেত্রে দেশে সবধরণের প্রবেশ পথে শক্তিশালী সিকিউরিটি (নিরাপত্তা) ও উন্নত কোয়ারান্টাইন (সঙ্গনিরোধ) ব্যবস্থা চালু রাখা। পাশাপাশি জরুরী অবস্থাকে সামাল দিতে প্রয়োজনীয় সকল কিছুর (যেমন- আইসিইউ, অক্সিজেন, ঔষধ, পিপিই) প্রস্তুতি রাখা আবশ্যক।

==============

অধ্যাপক ড. মোঃ সহিদুজ্জামান
লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3