গবেষক ও সাংবাদিকদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন প্রয়োজন

Shahiduzzaman

মতামত

ড. মোঃ সহিদুজ্জামান

বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়বস্তু ও গবেষণা একটি বিশেষায়িত ক্ষেত্র। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র কারণ বিজ্ঞান ও গবেষণার বিষয়বস্তু প্রযুক্তির বিকাশ, মানুষের জ্ঞান ও সচেতনা তৈরি এবং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণীতে বিশেষ ভুমিকা রাখে। তবে এই সেক্টরে কাজ করা মানুষগুলো সাধারণ মানুষদের সাথে ভাষাগত যোগাযোগে পারদর্শী নয়। ফলে বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো সহজভাবে সাধারণ মানুষদের কাছে তুলে ধরা তাদের কাছে দূরূহ। আর এ কাজটি করার জন্য বিশেষ মাধ্যম বা ব্যক্তির প্রয়োজন। সাংবাদিকতায় বিশেষ প্রতিবেদক বলা যেতে পারে যিনি বিজ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক তথ্য ও উপাত্ত সঠিকভাবে সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে পরিবেশেন করবেন।

আধুনিক বিজ্ঞান সাংবাদিকতার পথিকৃত হিসেবে ‘দিগদর্শন“ (অর্থাৎ দিক নির্দেশনা ) নামক একটি শিক্ষামূলক মাসিক পত্রিকা ছিল যা ১৮১৮ সালে শ্রীরামপুর, বাংলা, ভারত থেকে প্রকাশনা শুরু হয়েছিল। দিগদর্শন- পদার্থবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, ভূগোল, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদির উপর নিবন্ধ প্রকাশ করত। এটি বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পাওয়া যেত। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক সাংবাদিকতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্যাবলী। এছাড়া বিশ্বের নামী দামী অনেক পত্রিকা, জার্নাল ও ম্যাগাজিন বৈজ্ঞানিক সাংবাদিকতার প্রয়োগ করে থাকে।

মিডিয়ার কাজ সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে সঠিকভাবে তুলে ধরা। ভুল মেসেজ প্রচারিত হলে জনমনে বিভ্রান্তি ও আতংক ছড়াতে পারে। আবার বিভ্রান্তিকর শিরোনাম বিজ্ঞান ও গবেষণাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারে, পারে গবেষক, গবেষণা ও প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করতে। গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল সাংবাদিকরা সঠিক ও সহজভাবে জনসাধারণের কাছে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন। দেশের মিডিয়াগুলোতে বৈজ্ঞানিক বা বিশেষায়িত সংবাদিকতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। আবার যারা এসব কাজে নিয়োজিত তাদের সাথে শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের মধ্যে যোগাযোগের ব্যবধান রয়েছে যথেষ্ট। ফলে আমরা মাঝে মধ্যেই অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা এবং ভুল ম্যাসেজ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে দেখতে পাই। এ ক্ষেত্রে অসতর্কতায় যেমন বিভিন্ন বিভ্রান্তি তৈরি হয়, তেমনি দেখা দেয় নানা জটিলতা। জনস্বার্থই যেহেতু সাংবাদিকতার মূল বিষয়, তাই সেটা নিশ্চিতে বিজ্ঞানী বা গবেষকের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করে সহজভাবে বিষয়টা বুঝে নেওয়া জরুরি। তবে কাজটি মোটেই সহজ নয়। কারণ গবেষণাপত্র ও সংবাদপত্রের ভাষায় বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। সে জন্য সাংবাদিকদের যেমন বিজ্ঞান ও গবেষণার ভাষা সম্পর্কে মৌলিক ধারণা থাকা দরকার তেমনি গবেষক ও বিজ্ঞানীরও সংবাদমাধ্যমের উপযোগী ভাষা ও ভাষ্য সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা দরকার।

বাংলাদেশে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে গবেষণার খবরগুলো অস্পষ্ট এবং বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকাশিত হয়। এটি হয়ত অজ্ঞতার কারণে ঘটে থাকতে পারে। কারণ বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যারা আসেন তাদের সাধারণত বিশেষায়িত শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ থাকে না । বৈজ্ঞানিক বিষয় রিপোর্ট করা অন্যান্য রিপোর্ট করা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কয়েক সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ একজনকে সাংবাদিকতায় সুযোগ করে দিতে পারে, তবে বিজ্ঞান সাংবাদিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা এবং বিজ্ঞানের ব্যাপক জ্ঞানের প্রয়োজন। অতএব, এক্ষেত্রে বিজ্ঞানে ডিগ্রিধারী লোকদের নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। তবে ভাল বা আকর্ষনীয় বেতন দিয়ে বিষয়বিত্তিক বা বিজ্ঞান সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া অনেক মিডিয়ার জন্য সম্ভব নাও হতে পারে। তাই পরিস্থিতি বিবেচনায় বিজ্ঞানী বা গবেষকদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।

ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় অনেক সময় গবেষককের উপস্থিতিতে গবেষণার বিষয়বস্তু ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জনগুরুত্বপূর্ণ এবং প্রশংসনীয়। এধরণের আলোচনায় গবেষকের গবেষণার জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে সঠিকভাবে তুলে নিয়ে আসার দায়িত্ব উপস্থাপকের। কাজটি অবশ্যই সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তির। এছাড়া এসব আলোচনায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষক বা আলোচককে রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। আলোচনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত গবেষণার বিষয়বস্তু সুন্দরভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরা। ফলাফলের ভাল খারাপ দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, গবেষণার পদ্ধতি জানা যেতে পারে বা গবেষণার উদ্দেশ্য জানা যেতে পারে। তবে চ্যালেঞ্জ করা, অবৈজ্ঞানিক উপায়ে সমালোচনা করা বা হেয় করা, অনুৎসাহিত করা মোটেও ঠিক নয় এবং এগুলো আলোচনার উদ্দেশ্য হওয়া সমীচীন নয়। কিছু টেলিভিশন চ্যানেলে আমন্ত্রিত স্বনামধন্য অধ্যাপক ও গবেষকদের এসব অনুষ্ঠানে স্যার সম্মোধন করতে দ্বিধাবোধ করতে দেখা যায় যা আমাদের মত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভীষণ লজ্জিত করে।

অনেক মিডিয়া বেশি কাটতির জন্য মুখরোচক সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। ঘটনা যাহাই হোক, জনগন যেখানে প্রবল আগ্রহ রাখে সেভাবেই উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এখানে যে ঘটনাগত ব্যবধান ঘটে থাকে সেটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ বিজ্ঞান যখন জ্ঞান তৈরি করে, সাংবাদিকদের উচিত জনসাধারণের কাছে সঠিক জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া। তাই মিডিয়ার দৃষ্টি ভিঙ্গি পাল্টাতে হবে। কারণ সমাজ ও সংস্কৃতির গঠনমুলক পরিবর্তনে মিডিয়ায় ভূমিকা অপরিসীম। মিডিয়ার দৃষ্টি ভিঙ্গি পাল্টালে মানুষের দৃষ্টি ভঙ্গিও পাল্টাবে।

আবার একদিকে যেমন মিডিয়ার দায় রয়েছে তেমনি গবেষকদেরও দায় রয়েছে। গবেষক যখন কোনো সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলবেন তখন সতর্ক থাকতে হবে যেন তাঁর কথায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়। সংবাদমাধ্যমই হোক আর সামাজিক মাধ্যম হোক গবেষণার ফল প্রকাশে সাবধানতা অবলম্বন করা গবেষক ও বৈজ্ঞানিকের নৈতিক দায়িত্বও। উন্নত বিশ্বে এখন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে কথা বলতে গবেষকদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক দেশে একাডেমিশিয়ান ও গবেষকগণ তাদের প্রফেশনাল প্রোফাইলে মিডিয়ার সাক্ষাৎকার ও প্রকাশিত পপুলার আর্টিকেল যুক্ত করে থাকেন যা তাদের পেশাগত মূল্যায়নে ব্যবহৃত হয়।

প্রতিটি গবেষকের পপুলার আর্টিকেল (সাধারণ ভাষায়) বা সাধারণ মানুষের উপযোগী করে লেখার দক্ষতা অর্জন করা উচিত। মিডিয়ায় প্রকাশের জন্য প্রেস নোট বা সংবাদমাধ্যম উপযোগী সারাংশ তৈরি করে তা সরবরাহ করা প্রয়োজন। অন্যথায় তথ্য পরিবর্তন হয়ে মুখরোচক ও ভুলভাবে মানুষের কাছে চলে যাবে। গবেষকদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। তা না হলে এরকম দূর্ঘটনাটা ঘটার ঝুঁকি থেকেই যাবে।

অনেক ক্ষেত্রেই কারিগরি বিষয় নিয়ে পড়াশুনা ও কাজ করা মানুষের মধ্যে সংবাদ মাধ্যমে কিভাবে একটি বিষয় সহজভাবে উপস্থাপন করতে হয় সেটির অভিজ্ঞতা থাকেনা। সেক্ষেত্রে মিডিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট কারো সাথে আলোচনা করে পূর্ব প্রস্তুতি রাখা যেতে পারে। বিদেশে যখন একটি বিষয়ে গবেষণা প্রকাশিত হয়, অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রস্তুতি হিসেবে সেই গবেষণাটির মূল সারাংশ বা মুল ম্যাসেজটুকু তৈরি করে রাখা হয়। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগ অফিস রয়েছে যারা এ কাজটি করার জন্য। এসব জনসংযোগ অফিসে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রয়োজনে গবেষণার অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

শুধু বিজ্ঞান নয়, যে কোন বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। দেশীয় গবেষণার পাশাপাশি বিদেশের কোন গবেষণা বাংলাদেশের জন্য আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারে। তবে গবেষণার ফলাফল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জার্নালে প্রকাশিত হলে ভাল। সেক্ষেত্রে বিতর্কিত হওয়ার সুযোগ কম। আবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক যে কোন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে মিডিয়াতে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। গবেষণার বস্তুনিষ্ট ফলাফল যতবেশি সাধারণ মানুষদের উপযোগী করে প্রকাশিত হবে তত বেশি এর সুফল দেশ ও জাতি পাবে। দেশের পলিসি মেকার ও সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের মাঝে সহজ ও বোধগম্য উপায়ে দ্রুত পৌছাতে এর কোন বিকল্প নেই। তাই আমাদের দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোকে এই সেক্টরে জোর দেওয়া জরুরি।

বিজ্ঞানবিষয়ক খবর বা প্রতিবেদন তৈরি এবং টকশোর মতো অনুষ্ঠান করতে সাংবাদিক ও গবেষক উভয়ের যথাযথ প্রশিক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংবাদমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসা উচিত। কমবেশি প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সাংবাদিক আছেন। সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সাংবাদিক সহ আঞ্চলিক ও কেন্দ্রিয় সাংবাদিকদের নিয়ে প্রতিনিয়ত বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। এজন্য আলাদা বাজেট থাকতে পারে।

সাংবাদিকদের সমাজের প্রতি যেমন দায়বদ্ধতা রয়েছে তেমনি একজন গবেষকের আছে। এই পারস্পারিক দায়বদ্ধতা এবং পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে উভয়েই সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করলে বিজ্ঞান, গবেষণা এবং জনগণের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধন তৈরি হবে।

লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

  •  
  •  
  •  
  •