গণভবনে গেরস্থালিঃ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন

মতামত
ড. মোঃ সাইদুর রহমানঃ

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ১২তম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা করোনা অতিমারি থেকে দেশের জনসাধারণকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে কৌশলগত উপায় হিসেবে কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে এক ইঞ্চি জমিও ফাঁকা না রেখে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির নির্দেশনা দেন। এ নির্দেশ দেশের আপামর জনসাধারণ আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে শুধু গ্রাম নয় শহরের মানুষও এগিয়ে এসেছে। মানুষ ইদানিং রাস্তার দু’পাশের খালি জায়গায়ও বিভিন্ন ধরণের ঘাসসহ মৌসুমি ফসল আবাদ করছে। কলা, পেয়ারা, মরিচ, সীম, লাল শাক, পালন শাক, ঢেড়শ, বরবটি, ব্রকলি, টমেটো, ধনিয়া পাতা, রসুন, পেয়াজ, গাজর, লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি আবাদ করে নিজেরা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাজারে সরবরাহ করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি শুধুই একটি ঘোষনা দিয়েছেন যে কোন জমি ফাঁকা রাখা যাবে না তা কিন্তু নয়। তিনি গণভবনে গড়ে তুলেছেন গেরস্থালি, কৃষির এক অনন্য দৃষ্টি জুরানো সম্ভার যেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ, হাস-মুরগি ও গরু ছাগল।

জনাব শাইখ সিরাজ তাঁর বহুল প্রচারিত ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গণভবন এলাকায় জননেত্রী শেখ হাসিনার যে কৃষির প্রতি অনুরাগ আছে তা মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। পুরো অনুষ্ঠান জুড়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনার কৃষির প্রতি ভালবাসাকে শাক-সবজি, ফুল-ফল, হাস-মুরগী, গবাদিপশু-প্রাণি, মাছ পালনসহ সকল ক্ষেত্রে তাঁর সরাসরি সম্পৃক্ততা তুলে ধরেছেন। দেশের রাজধানীতে রাষ্ট্রীয় অফিস কাম আবাসিক ভবনে বিশ্বমানের উন্নত জীবন ব্যবস্থা উপভোগ না করে কৃষি ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় নিজেকে সম্পৃক্ত রাখা দেশের প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই প্রশংসা পাবার যোগ্য কোন সন্দেহ নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ অনন্য দৃষ্টান্ত কৃষি সংশ্লিষ্ঠ সকল নীতি-নির্ধারক, প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে অনুসরণ করা উচিৎ কারণ এটা সত্যিই একটা অনন্য অনুসরণযোগ্য বাস্তবধর্মী কাজ। দেশরত্ন প্রধানমন্ত্রীর অগনিত ভক্ত ও অনুসারীরা তাঁকে কিছুটা ফলো করলেই দেশের কৃষি এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে যাবে। দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য মহোদয়গণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ করবেন এটাও একটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা।

জনাব শাইখ সিরাজ তাঁর অনেকটা ব্যক্তি চিন্তা ও দূরদর্শিতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে দুর্বার গতিতে দেশব্যাপি ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁর এ উদ্যোগে কোন নেতিবাচক পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করি না তার প্রমাণ তাঁর গায়ের সেই জলপাই রঙের শার্ট। কৃষি প্রযুক্তি বিশেষ করে ছাদ কৃষিকে তিনি উপশহর থেকে শুরু করে জেলাশহর, রাজধানী এবং আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এখন দেশে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সচিব, নায়ক-নায়িকা, শিল্পপতিদেরও রয়েছে ছাদ বাগান। সংসারের চাহিদা, পরিবেশ রক্ষা, কায়িক শ্রম, মানসিক প্রশান্তি লাভ সবই সম্ভব হয়েছে ছাদ কৃষির কল্যানে। এটাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দেশব্যাপি বিশাল এক সার্ভিস মার্কেট। আমার এক এমএস ছাত্রীর থিসিসে উঠে এসেছে ছাদ বাগানের মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থান ও বিনোদনের সুযোগ। শহরের শত শত শিক্ষিত যুবকরা সরবরাহ করছে বিভিন্ন ধরণের শাক-সবজি, ফলমূলের চারা, সরবারাহ করছে তৈরি টবভর্তি মাটি, সার, পানি দেবার সরঞ্জামাদী, কেউ কেউ এগিয়ে আসছে ছাদ বাগানের নতুন নতুন ডিজাইন নিয়ে। ছাদ রক্ষার কৌশলও উদ্ভাবন করেছেন অনেক প্রকৌশলী। জনাব শিরাজের চ্যানেল আইতে প্রচারিত প্রতিটি পর্ব দেখে মানুষের উদ্বুদ্ধ হওয়া ছাপিয়ে গেল শেখ হাসিনার কৃষির প্রতি ভালবাসায়। এখন থেকে সবাই প্রধানমন্ত্রীর কৃষি প্রেমকেই উদাহরণ দিবে। যিনি ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে প্রথম ১২ কোটি টাকা গবেষণায় বরাদ্দ দিয়ে কৃষিকে এগিয়ে নেবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আজ সে কৃষিই হয়েছে নির্ভরতার প্রধান সোপান।

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সংশ্লিষ্ঠ সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। তাদেরকে বুঝানো দরকার কৃষিকে নিয়েও গর্ব করা যায়। বাবা, মা কৃষক হলেও গর্ব করার অনেক সুযোগ থাকে। দরকার শুধু ভাল মানসিকতার। দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যকে নিয়ে অহংকার করতে পারেন তাহলে আমরা কেন নয়, আমাদের ছেলে মেয়েরা কেন নয়। এছাড়া দেশের সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ প্রশাসন এদেরও কৃষিকাজের সহায়ক শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসতে হবে। প্রকৃত শিক্ষক ও বিজ্ঞানীরাই স্ব স্ব শিক্ষা ও গবেষণায় নেতৃত্ব দিবেন তাহলেই শিক্ষা ও গবেষণায় কার্যকর অগ্রগতি আসবে। যার যা কাজ তাকে সেই কাজে মনোযোগী হতে হবে এবং অন্যদেরকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করতে হবে। অন্যথায় আমরা কেবল ক্ষমতার বহি:প্রকাশ দেখতে পাবো। দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে চরমভাবে।

আসলে কৃষি শিক্ষায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিক্ষার্থীদের কৃষি বিষয়ে শিক্ষা দিয়েই অনেক বড় কিছু করে ফেলেছে বলে মনে করে। কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেশের কৃষকদের সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিৎ। যেকোন সমস্যা নিয়ে কৃষি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ষ্ঠানে কৃষিকাজে নিয়োজিত উদ্যোক্তারা আসলে তাদেরকে গুরুত্ব দিতে হবে। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ফিলিপাইনস এর আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইরি) বছরের বিভিন্ন সময়ে ফামার্স ডে পালন করে এবং ঐ দিবসগুলোতে তাঁরা অফিস থেকে বেরিয়ে এসে কৃষকদের বা কৃষি উদ্যোক্তাদেরকে সার্ভিস বা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এতে কৃষকরা এবং কৃষি উদ্যোক্তারা দারুণভাবে উপকৃত হন।

আমাদের দেশে কৃষক, গার্মেন্টস কর্মী, সার্ভিস প্রদানকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মীবৃন্দ, বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জনকারীদের আমাদের সম্মান জানানো উচিৎ। তাঁদেরকে সম্মান প্রদর্শন করলে তারা উৎসাহিত হবে। বেশি বেশি উৎপাদনে এগিয়ে আসবে। উন্নত দেশ হতে হলে আমাদের ব্যবহার ও মানসিকতার উন্নয়ন হওয়া জরুরি। যেটা রাতারাতি কোথাও হয়নি বা হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন আমাদেরকে চলতে হবে। আমরা এটা জানি যে, প্রকৃত শিক্ষা মানুষের অভ্যাস ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটায়। চলুন আমরা মেধা আর সুশাসন অনুশীলনের মাধ্যমে দেশের মানুষ ও সমাজ ব্যবস্থার কাংখিত পরিবর্তন আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখি।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর কর্ম ও প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছেন। তাঁকে সবাই সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। শুধু কথায় দেশ সেবার কথা না বলে কাজে প্রমাণ করতে হবে। বলা হয়ে থাকে রোম ওয়াজ নট বিল্ট ইন এ ডে বা জাপানীরা পরিশ্রমী জাতি হিসেবে একদিনে তৈরি হয়নি। আইনের শক্ত প্রয়োগ ব্যতীত কোন দেশ দূর্নীতিমুক্ত হয়েছে এমন প্রমান কোথাও দেখা যায় না। পৃথিবীর বহুদেশ একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উন্নত দেশে পরিনত হয়েছে। আমাদেরকেও কোন না কোন দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন নেতার নেতৃত্বে ধৈর্য ধরে এগিয়ে যেতে হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলেই দেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রেখে দেশের মানুষ তাঁর ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বলেই আমরা কাংখিত স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যারা দেশের উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের সবাইকেই আমাদের মূলায়ন করতে হবে। আসুন আমরা সঠিক নেতৃত্বের পতাকাতলে থেকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই এবং পরিনত হই উন্নত ও সমৃদ্ধ এক নতুন বাংলাদেশে।

লেখকঃ প্রফেসর ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ-২২০২; ইমেইলঃ saidur.rahman@bau.edu.bd

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3