তবে কি আগামী দিনে ডেঙ্গু নতুন মহামারী রূপে আবির্ভূত হতে পারে ?

মতামতঃ

দেশ নাজেহাল ডেঙ্গুর প্রকোপতায়, বিগত ২২ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে ডেঙ্গু তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০ সালে দেশে প্রথম ডেঙ্গু সনাক্ত করা হয় ঢাকায়। সেই সময় ডেঙ্গুকে “ঢাকা ফিভার” বলে ডাকা হতো। সময়ের পরিক্রমায় গড়িয়েছে প্রায় ৬২ বছর। প্রকোপ তেমন ছিলো না বলে ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত করা হলেও সেটার গুরুত্ব ততটা ছিলোনা।

তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর তান্ডব চোখে পড়ার মতো। দেশে প্রথম ব্যপকভাবে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০০০ সালে, সে বছর প্রায় ৫,৫৫১ জন মানুষ ডেঙ্গুর লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ৯৩ জন মানুষ মারা যায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রটাও মোটামুটি একই রকম ছিলো। গত দশকের শেষভাগ থেকে এই দশকের শুরুতে গোটা দক্ষিণ এশিয়াকে নাড়িয়ে দেয় এই ডেঙ্গুর প্রকোপতা। বর্তমানে ডেঙ্গু ১২৫ টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে প্রতি বছর গড়ে সংক্রমিত হচ্ছে ৪০ কোটি মানুষ এবং ৪০ হাজারের মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বশেষ পাঁচ বছরের চিত্র দেখলে এর ভয়াবহতা আরো পরিষ্কার হবে। ২০১৮ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর হারছিল ০.২৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে ০.১৮ শতাংশ, ২০২০ সালে ০.৫০ শতাংশ, ২০২১ সালে ০.৩৭ শতাংশ, ২০২২ সালে ০.৪৫ শতাংশ এবং ২০২৩ এ ৬ অগাস্ট পর্যন্ত ০.৫০ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালে সবচেয়ে বেশি, ২৮১ জন রোগী মারা যায়। এর আগে ২০১৯ সালে মৃত্যু হয় ১৭৯ জনের। ২০২০ সালে ৭ জন এবং ২০২১ সালে ১০৫ জন মারা যায়। চোখ কপালে উঠার মতো অবস্থা, যখন ২০২৩ এর ৬ অগাস্ট তারিখ পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০৩জনে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল ব্রিফিংঅনুযায়ী,

গত জুন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫,৯৫৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলো, সেখানে জুলাই মাসের ২৯ তারিখ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৮,৪২৯ জন। সেই হিসেবে গত মাসের তুলনায় প্রায় ৭ গুন বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এই মাসে। শুধু আক্রান্তের হার বেড়েছে এমনটা নয়, মৃতের হার ও বেড়েছে বহুগুনে। চলতি বছরের জুলাইয়েই শুধু মাত্র ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২০০ জন। এ বছরের বাকিটা সময় এখন দেখার বিষয়, তবে আশংকায় রয়েছে মানুষজন ।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ কেনো বেশি তা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে পারে অনেকের মনে। এর সম্ভব্য কিছু কারন লক্ষণীয়।

জলবায়ু এবং ভৌগোলিক অবস্থান:  দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরক্ষরেখা এবং উপক্রান্তীয়/ক্রান্তীয় পরিবেশের কাছাকাছি ।  আর বাংলাদেশ অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় (SE)  দেশগুলির মতো, ডেঙ্গু ভেক্টরের জন্য আদর্শ আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। ডেঙ্গু সংক্রমণের উপযুক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা মশার বংশ বৃদ্ধি এবং ভাইরাল প্রতিলিপির জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরি করে। এই পরিস্থিতিতে, ডেঙ্গু সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে যখন বর্ষাকালে বিভিন্ন জায়গায় স্থির হয়ে থাকা জমানো পানি  মশার প্রজনন ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করে।

দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব: দ্রুত নগরায়ণ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঘনবসতি পূর্ণ এলাকায় দুর্বল অবকাঠামো গড়ে উঠছে, পয়নিষ্কাশন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশে এখন প্রায়  ১৬.৫ কোটি মানুষ বসবাস করছে, সেই হিসেবে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি  বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ১১১৯জন। উপরন্তু, আমরা দেখেছি, প্রাদুর্ভাবটি প্রধানত ঢাকা শহরকে ব্যপক, এর একটি কারন হতে পারে শুধুমাত্র ঢাকা শহরে ১ কোটি ২ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে, জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ২৩,০০০ জন।

কার্যকর ভেক্টর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অভাব:  অপর্যাপ্ত বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ মশা নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা, যেমন ফগিং, লার্ভিসাইডিং এবং প্রজনন স্থান নির্মূল, মশার জনসংখ্যা অব্যাহত রাখা এবং ডেঙ্গুর বিস্তারে ভূমিকা রাখে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের অনেক পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নে কতটুকু সফলতা তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েছে। বরাবরের মতোই দেখা যায় ডেঙ্গু নির্মুলে ডেঙ্গুর চিকিৎসায় জোর দিচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়।

জন সচেতনতার অভাব: ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেক মানুষ এখনো সচেতন না।সম্প্রতি ঢাকা শহরে পরিচালিত একটি  KAP সার্ভেতে দেখা গেছে মাত্র ৫২ শতাংশ মানুষের ডেঙ্গু নিয়ে সম্যক জ্ঞান আছে। বাকি ৪৮ শতাংশ মানুষ এখনো ডেঙ্গু নাম শুনলেও সচেতনার বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই।

ডেঙ্গু প্রতিরোধ কিংবা নির্মুল করতে চাইলে এখনিই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।  তা নাহলে হয় তো ডেঙ্গু আগামীতে করোনার মতো মহামারী রূপ ধারন করতে পারে। যেহেতু ভৌগলিকভাবে আমরা খুবই ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছি সেক্ষেত্রে আমাদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে জনমনে। বিশেষকরে, যেখানে সেখানে পানি জমিয়ে রাখা বন্ধ করতে হবে। নিয়মিত বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার করতে হবে। আর সর্বোপরি ডেঙ্গু সংক্রমণকারী মশা নিধনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি ডেঙ্গু ও মশা নিয়ে গবেষণায় উৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে দেশি বিদেশি গবেষকদের সমন্বয়ে এক্সপার্ট প্যানেল তৈরি করতে হবে, যাতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রনের পথ সুগম হয়।

লেখক : ডিপার্টমেন্ট অফ মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন , ভেটেরিনারি সাইন্স অনুষদ , বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয় , ময়মনসিংহ।

  •  
  •  
  •  
  •