শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্নধারদের কাছে প্রত্যাশা
মতামতঃ
সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন
দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিপরায়ণ মানসিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচিত হয় সেটির শিক্ষক দ্বারা, শিক্ষকের কর্মদক্ষতা, সক্ষমতা, মেধা ও জ্ঞানভিত্তিক কর্মকাণ্ডের সম্মিলিত প্রয়াসের দ্বারা শিক্ষাকর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে। অর্থাৎ শিক্ষকরাই হলো প্রতিষ্ঠানের প্রধান স্তম্ভ বা মূল চালিকাশক্তি । শুধু শিক্ষাই নয়, সারা বিশ্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানমর্যাদা নিরূপণ হয় শিক্ষা ও গবেষণার মানের উপর ভিত্তি করে- যা মূলত নির্ভর করে শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াসের উপরই। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই শিক্ষকরাই নানাভাবে নিগৃহীত ও ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর শোষণ ও অধিকার হরণের মূলে রয়েছে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে নিয়োগ পেয়েই তারা নিজের গদি সুরক্ষা ও হীনস্বার্থ সিদ্ধির জন্য নিজের পক্ষে একটি তোষামোদী গ্রুপ সৃষ্টি করে। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বিদ্যমান ঐক্যের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে, নানা লোভ-লালসা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজের পক্ষে টেনে দল ভারী করার চেষ্টা করে। ফলে অল্প কিছুদিনেই শিক্ষকদের মধ্যে সুস্পষ্ট একটি বিভাজন লক্ষ্য করা যায় । এক্ষেত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তি ব্রিটিশদের “Divide and Rule” পলিসি অবলম্বন করে নিজের মনের মতো (স্বেচ্ছাচারী মনোভাব) প্রশাসন পরিচালনার অপচেষ্টা করে এবং তোষামোদী গ্রুপের সহযোগিতায় কখনো কখনো সফলও হয়। কর্ণধারের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল, ক্ষমতার দাপট ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যই এসব করা হয়। এমন হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মানসেই প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব অবনমিত করা হয়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম পালনে একদল সব সময় সচেষ্ট থাকে, তাদের কাছে শিক্ষা গবেষণার মূল্য অতি নগণ্য। আর অপর গ্রুপকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সব সময় সচেষ্ট থাকতে হয়। ফলে তারাও শিক্ষা-গবেষণায় মনোনিবেশ করার পরিবেশ থেকে বঞ্চিত হয় । এমন অবস্থা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। কর্ণধারদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত।
কর্ণধারদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটাও স্বচ্ছ নয়। কর্ণধার নিয়োগে প্রায়ই মেধা, দক্ষতা, সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা ও ম্যানেজারিয়াল স্কিলনেস এসব বিবেচনা করা হয় না বললেই চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই নিয়োগ তোষামোদি ও সংযোগস্থাপনের দক্ষতার (লবিং) উপরই বেশি নির্ভর করে। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষা ব্যবস্থায়। এমনও দেখা যায়, যিনি কখনো চিন্তাই করেনি, বা কারো ভাবনার মধ্যে নেই এমন কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়। ফলে তার অভিজ্ঞতার অভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব নীতি নৈতিকতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নিয়োগের সঠিক কোন নীতিমালা না থাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি তোষামোদি বা অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে কার্যসম্পাদন হয় বলে শুনা যায়। আর এভাবে নিয়োগ পাবার কারণে কারো কাছে কোন দায়বদ্ধতা থাকে না। ফলে সে স্বৈরচারী হয়ে উঠে। এমনও শুনা যাচ্ছে একজন মেধাবি ছাত্র ঘুষের টাকা জোগার করতে না পারার কারণে চাকুরি না হওয়ায় মনের কষ্টে সে আত্মহত্যা করেছে। বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যায়ের কর্নধারদের বিষয়ে অবৈধভাবে টাকা আত্মসাত, ক্ষমতার অপব্যহার নৈতিক স্ফলনসহ বিভিন্ন অভিযোগে চাকুরিচ্যূত এমনকি জেলেও যেতে হয়েছে। অনেকে নিজের হীনস্বার্থ সিদ্ধির জন্য সর্বত্র অর্থাৎ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নানাবিধ বিভাজন সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষাকে মারাত্মকভাবে ব্যহত করে। অনেকে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে থেকে মিথ্যার আশ্রয় প্রতারণা ফাঁদ, কথা দিয়ে কথা না রাখা, মুনাফেকী ও বিশ্বাসঘাতকতা করার মত জঘন্য কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। ফলে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার যোগ্যতা হারায়। অযোগ্য ব্যক্তিরাও নানা কূটকৌশলে নিয়োগ পেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও গবেষণাকে মারাত্মক হুমকীর মধ্যে নিপতিত করছে। অনেকেই বলে- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়োগ দেয়া হয় না, নিয়োগ নেয়া হয় – ছলে বলে কৌশলে বা কিছুর বিনিময়ে।
যিনি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তার ইচ্ছার উপরই সব কিছু নির্ভর করে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। কর্ণধারের অনিচ্ছায় শিক্ষকদের সম্মিলিত প্রয়াস নিদারুনভাবে ব্যহত হয়। ফলে এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে শিক্ষা ও গবেষণায়। যে কারণে বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রভাব সুস্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়- বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গুণগতমান নির্ধারক টাইমস হায়ার এডুকেশন ২০২৪ র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের মাত্র ৯টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের ৮০১ থেকে ১০০০ এর মধ্যে আছে দেশের ৪ বিশ্ববিদ্যালয়। তার মধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ- সাউথ ইউনিভার্সিটি। এবারই প্রথম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পিছনে ফেলে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সামনে চলে এসেছে।
যে পাঁচটি (শিক্ষার মান, শিক্ষার্থী-শিক্ষকের অনুপাত, গবেষণার মান, সাইটেশন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী) সূচকের ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ করা হয় সেগুলোর সব কয়টি বিষয়ের সাথে শিক্ষকগণই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সেই শিক্ষকগণকে নিয়ে যদি নানা রকম বিবেধ ও গ্রুপিং সৃষ্টি করা হয় তাহলে সবকিছই মুখ থুবড়ে পড়বে সন্দেহাতীতভাবে। অনেক সমস্যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সামগ্রিক বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, দক্ষতা, মেধার উপরই অনেক কিছু নির্ভর করে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষক আছেন যাদেরকে উপযুক্ত পরিবেশ ও সুযোগ দিলে তারা শিক্ষা ও গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারতেন। সর্ব বিষয়ে মেধা সৃষ্টি ও বিকশিত করার পরিবেশ সংরক্ষণ করার প্রাথমিক দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার বা কর্তৃপক্ষের ।
মোটকথা, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কম্পোনেন্ট হলো শিক্ষক আর সেই শিক্ষকদের সঠিকভাবে ব্যবহার ও পরিচালনার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান প্রধানের। ন্যায়-নীতি-সততা ও নৈতিকতার সঙ্গে সকল লোভ-লালসার উর্ধ্বে উঠে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে না পারলে দেশের ভবিষ্যৎ মেরুদন্ড শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না। যদি দেশে শিক্ষার্থীর মধ্যে মেধা সৃষ্টি করা না যায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তৈরি করা না যায় তা হলে আমরা যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের কথা বলছি তা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
লেখকঃ
ড. সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন
প্রফেসর (অব:)
এনিমেল ব্রিডিং ও জেনেটিক্স বিভাগ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
মযমনসিংহ
ও
ভাইস-চ্যান্সেলর (প্রাক্তন)
পবিপ্রবি, পটুয়াখালী