কাঁকড়া চাষ : সম্ভাবনার নতুন দুয়ার (ভিডিও)

কক্সবাজার সংবাদদাতা:
চিংড়ি চাষে ভাইরাসের আক্রমণসহ নানা প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকির কারণে কক্সবাজারের চিংড়ি চাষীরা এখন ঝুঁকছে কাঁকড়া চাষের দিকে। এখন কক্সবাজারের উপকূলীয় বিভিন্ন উপজেলায় ব্যাপকভাবে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। কক্সবাজার ছাড়াও দেশের অন্যান্য উপকূলীয় জেলাতেও বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া চাষ হওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে গেছে। বিদেশের বাজারে পণ্যটির দারুণ চাহিদা থাকায় এবং স্বল্প পরিশ্রমেই অল্প সময়ে লাভবান হওয়া সম্ভব হওয়ায় এটি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাত হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

এক সময়ের অবহেলিত এ জলজ প্রাণিটির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে সারা বিশ্বে। রান্নার পর এর স্বাদে এক শ্রেণির ভোজন রসিক মুগ্ধ হন। চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে খাদ্য হিসেবে কাঁকড়ার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেলে ১৯৯৩ সাল থেকে দেশের উপকূলীয় জলাশয়ে এর চাষ শুরু হয়। এখন এটি দেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

বিদেশে কাঁকড়ার চাহিদা এখন আকাশছোঁয়া। কাঁকড়া রপ্তানি করে এখন প্রতিবছর গড়ে আয় হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। রপ্তানি তালিকায় অপ্রচলিত এ ‘পণ্য’ই বদলে দিচ্ছে লাখো মানুষের ভাগ্য। যে হারে চাহিদা বাড়ছে তাতে ‘সাদা সোনা’ হিসেবে পরিচিত গলদা চিংড়িকে অদূর ভবিষ্যতে হার মানাতে পারে এ জলজ সম্পদ।

জানা যায়, চিংড়ি চাষে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আর আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতনের কারণে কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার চিংড়ি চাষীরা এখন কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার মেট্রিন টন কাঁকড়া রপ্তানি করছে, যা দেশের অর্থনীতিকে দিচ্ছে ঊর্ধমুখী গতি।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অমিতোষ সেন জানান, কক্সবাজারে মূলত দুই ধরনের কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। একটি সফ্‌ট সেল ক্র্যাব, অপরটি হার্ড সেল ক্র্যাব। হার্ড সেল ক্র্যাব জীবিত অবস্থায় এবং সফ্‌ট সেল ক্র্যাব হিমায়িত অবস্থায় বিদেশে রফতানি করা হয়। কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, সদর ও উখিয়ায় উভয় পদ্ধতিতেই কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে।

জানা যায়, ভাসমান খাঁচা পদ্ধতিতে কাঁকড়া চাষ করে ভাগ্য বদল করছে কক্সবাজারের উদ্যোগী তরুণেরা। শক্ত খোলস থেকে নরম খোলসে রূপান্তরের নতুন এ পদ্ধতির কাঁকড়া চাষ করে নরম খোলসযুক্ত কাঁকড়া রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা। সাগর বা নদী থেকে সংগ্রহ করা হয় কাদা মাটির কাঁকড়া। তারপর বিশেষ ভাবে তৈরি খাচায় ঢুকিয়ে মাচায় ভাসানো হয়। দুই সপ্তাহ অন্তর কাঁকড়া তার শক্ত খোলস পরিবর্তন করে।এসময় কাঁকড়ার খোলস বেশ নরম থাকে। আর সাথে সাথে নরম খোলসযুক্ত কাঁকড়া খাচা থেকে সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দেয়া হয় যথাস্থানে।

কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়া চাষ অনেক সহজ। লাভও ভালো। এতে নি:স্ব হওয়ার আশংকা নেই।

উখিয়া বালুখালীর চিংড়ি চাষী বাবলু চৌধুরী জানান, তিনি দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি চাষ করে আসছিলেন। কিন্তু চিংড়ি ঘের করে পর পর কয়েক বছর ভাইরাসের আক্রমণে সর্বশান্ত হওয়ার পর ২০১১ সাল থেকে চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে ঘেরে কাঁকড়া চাষ করছেন। কাঁকড়া চাষে চিংড়ির মতো পোনা কিনতে হয় না। প্রাকৃতিকভাবেই নোনা পানিতে কাঁকড়া জন্মায়। নদী থেকে ঘেরে পানি উঠালেই বিনে পয়সায় লাখ লাখ পোনা পাওয়া যায়। এর পর নার্সিংয়ের মাধ্যমে এগুলো বড় করে তোলা হয়। ১৮০ গ্রামের ঊর্ধ গ্রেডের কাঁকড়ার স্থানীয় বাজার দর কেজি প্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।

চাষীরা জানান, মাত্র একশ’ শতাংশ জমিতে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে বছরে গড়ে ৩০০ কেজি কাঁকড়া উৎপাদন করা সম্ভব, যার বাজার মূল্য প্রায় দুই লাখ টাকা।

চাষীরা আরো জানান, কাঁকড়ার খামারে চিংড়ির মতো ভাইরাসের দুশ্চিন্তা নেই। প্রক্রিয়াকরণে জটিলতা বা দ্রুত পচনেরও ভয় নেই। কাঁকড়া চাষী ও রফতানিকারকদের মতে, পোনা উৎপাদনে হ্যাচারি স্থাপন, স্থানীয় পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাপনা, ব্যাংক ঋণ ও পুলিশি হয়রানি দূর করা গেলে কাঁকড়া উৎপাদন করে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

সূত্র জানায়, ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হতো মূলত প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কাঁকড়া। চাষীরা নদী, সাগর, ডোবা, জলাশয় থেকে কাঁকড়া আহরণ করে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে সেগুলো রাজধানীতে পাঠাতেন। রপ্তানিকারকরা সেগুলো নিজেদের মতো করে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চাষ করা কাঁকড়াও রপ্তানি হচ্ছে।

এখানে ২০০৩ সালে প্রথম কাঁকড়ার পোনা উৎপাদন ও চাষ বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। গত বছর (২০১৪ সাল) নভেম্বরে কাঁকড়ার পোনা উৎপাদনের নতুন গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। গভীর সমুদ্র থেকে ধরে আনা মা কাঁকড়া হ্যাচারিতে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে ডিম থেকে বের করে আনা হয় ‘জুইয়া’ (কাঁকড়া ডিম ছাড়ার পর পোনার প্রাথমিক অবস্থা)। এরপর সেই ‘জুইয়া’ প্রযুক্তি কেন্দ্রের বিশেষ ল্যাবে সংরক্ষণ করে বাঁচিয়ে রাখা হয়। দীর্ঘ গবেষণার পর চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সক্ষম হয় গবেষক দল।

কাঁকড়া চাষীদের মতে, এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন ও বিপণন শুরু হলে দেশে কাঁকড়া চাষের নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে। তখন সনাতন পদ্ধতি বাদ দিয়ে চাষীরা এ পদ্ধতি অনুসরণ করবেন।

মৎস্য বিজ্ঞানিদের মতে, কাঁকড়া আর্থ্রোপোডা পর্বের একটি ক্রাস্টাসিয় প্রাণি। এদের শরীর একটি পুরু বহিঃকঙ্কালে আবৃত থাকে এবং এদের এক জোড়া দাঁড়া থাকে। এ পর্যন্ত কাঁকড়ার ৬,৭৯৩টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। সব সাগরেই কাঁকড়া পাওয়া যায়। এছাড়া মিঠা পানির ও স্থলবাসী কাঁকড়াও পাওয়া যায়। বিশেষতঃ গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে। কাঁকড়া বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের হতে পারে। যেমন পি কাঁকড়ার দৈর্ঘ্য কয়েক মিলিমিটার (en : pea crab), আবার জাপানি মাকড়সা কাঁকড়ার (en : japanese spider crab) একটি পায়ের দৈর্ঘ্যই ৪ মিটার। আমাদের বঙ্গোপসাগরেও সহস্রাধিক প্রজাতির কাঁকড়া রয়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ সীমানায় ২১ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া যায়। এসব কাঁকড়ার মধ্যে মাইলা, শাইলা, সিরোটা ও শীলা প্রজাতি উল্লেখযোগ্য। মাইলা ও শীলা জাতের কাঁকড়া সবচেয়ে উন্নতমানের। তাই বিদেশে এগুলোর চাহিদা বেশি।

বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত কাঁকড়ার মৌসুম। বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে প্রায় ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু সরকারিভাবে এটি এখনও রপ্তানি পণ্য হিসেবে গণ্য হয়নি। কাঁকড়া আহরণ পরিবেশের ক্ষতি করে এ যুক্তিতে সরকার ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে দেশজুড়ে কাঁকড়া আহরণ ও রপ্তানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে বিদেশে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের কাঁকড়ার বাজার দখল করে নেয় ভারত, মিয়ানমারসহ কয়েকটি দেশের ব্যবসায়ীরা। কিছুদিন পরে কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে সরকার রপ্তানির অনুমতি দিলেও আহরণের ক্ষেত্রে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়।

কাঁকড়ার প্রজনন ও শরীরতত্ত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব মেরিন সায়েন্সেসের এক বিভাগীয় গবেষণায় বলা হয়েছে, কাঁকড়ার শক্ত খোলসের ভেতর লুকিয়ে আছে কোটি কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা। ‘উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাঁকড়া চাষের সম্ভাব্যতা পরীক্ষণ’ শীর্ষক ডিএফআইডির আর্থিক সহায়তায় ওই গবেষণাটি সম্প্রতি সমাপ্ত করেন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাফর।

গবেষণায় উঠে এসেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাঁকড়ার বাজার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৯৩ সাল থেকে সনাতন পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পুকুরে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়। ১৯৯৫ সালে হংকংয়ে বাণিজ্যিকভাবে কাঁকড়া রপ্তানির মাধ্যমে শুরু হয় অর্থনৈতিক গতিশীলতা। বর্তমানে শুধু মালয়েশিয়াতেই প্রতিবছর ৮০০ থেকে এক হাজার টন কাঁকড়া রপ্তানি হয়। এছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ান, জাপান, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমার, শ্রীলংকা, কোরিয়া এবং ইউরোপের কয়েকটি দেশসহ মোট ১৮টি দেশের বাজারে বাংলাদেশের কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে।

কাঁকড়ার পুষ্টিমান বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. শাহ মোহাম্মদ কেরামত আলী বলেন, ‘কাঁকড়া খুবই সুস্বাদু। এতে একটি পরিপূর্ণ সামুদ্রিক মাছের সমপরিমাণ ভিটামিন ও প্রোটিন পাওয়া যায়।’ তবে ঢালাওভাবে কাঁকড়া রপ্তানির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হবে বলে অভিমত দিয়েছেন ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’র (আইইউসিএন) রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. নিয়াজ আহমদ খান।

তিনি বলেন, ‘কাঁকড়ার বেশ কিছু প্রজাতি আইইউসিএন প্রণীত রেডলিস্ট (বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর তালিকা) অন্তভুক্ত। এ কারণে কাঁকড়ার চাষ সম্পর্কে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সচেতনতার মাত্রা আরো বাড়াতে হবে।’

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: