অবশেষে বন্ধ হয়ে গেল বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র

দিনাজপুর প্রতিনিধি:
কয়লার অভাবে অবশেষে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের একমাত্র কয়লাভিত্তিক দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কয়লা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় রোববার রাত ১০টায় উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। এতে চরম বিদ্যুৎ সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগের আট জেলায়। এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডেও।

এদিকে আশ্বাস দিয়েও কয়লা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় ইতিমধ্যেই অপসারণ করা হয়েছে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দীন আহমদকে।

সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নুরুজ্জামান চৌধুরী ও উপমহাব্যবস্থাপক (স্টোর) খালেদুল ইসলামকে এবং তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়েছে মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) ও কোম্পানি সচিব আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে।

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের তিনটি ইউনিট চালু রাখতে দৈনিক প্রয়োজন ৫ হাজার ২০০ টন কয়লা। কিন্তু বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি চলতি জুলাই থেকে কয়লার সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় বন্ধ হয়ে যায় ১২৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইউনিট।

অপর ১২৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি ইউনিট এর আগে থেকেই বন্ধ ছিল। আর ২৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন তৃতীয় ইউনিটটি কোনোমতে চালু রাখা হয়। কিন্তু কয়লা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রোববার রাতে তৃতীয় ইউনিটটিরও উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হতে হয়। ফলে ৫২৫ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল।

বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড নেসকোর রংপুর জোনের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদৎ হোসেন সরকার যুগান্তরকে জানান, রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় প্রতিদিন ৬৫০ মেগওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এর মধ্যে ৫২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। কিন্তু কয়লা সংকটের কারণে এক মাস ধরে বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২টি ইউনিট বন্ধ থাকায়, সেখান থেকে মাত্র ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসত। এ কারণে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, এখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ হওয়ায় এ ঘাটতি আরও বাড়ল।

তিনি আরও জানান, বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হলেও বাইরে থেকে বিদ্যুৎ এনে চাহিদা পূরণ করা হবে। তবে এতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেই সঙ্গে লোডশেডিংও হতে পারে।

জানা গেছে, একটি স্টোপ থেকে নতুন স্টোপে যন্ত্রপাতি স্থানান্তরের জন্য ১৬ জুন থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। পুনরায় কয়লা উত্তোলন শুরু হবে আগস্টের শেষের দিকে। এ সময়ের মধ্যে পার্শ্ববর্তী বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কয়লার মজুদ রয়েছে বলে ২০ জুন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি) নিশ্চিত করে খনি কর্তৃপক্ষ।

বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান জানান, ২০ জুন খনি কর্তৃপক্ষ পিডিবিকে নিশ্চিত করে খনির কোল ইয়ার্ডে ১ লাখ ৮০ হাজার টন কয়লা মজুদ রয়েছে। মজুদকৃত এ কয়লা দিয়ে আগস্ট পর্যন্ত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সচল রাখা যাবে বলে নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু জুলাইয়ের শুরু থেকেই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে হঠাৎ কয়লার সরবরাহ কমিয়ে দেয় খনি কর্তৃপক্ষ। ৪-৫ দিন আগে কর্তৃপক্ষ পিডিবিকে জানিয়ে দেয়, খনির কোল ইয়ার্ডে কয়লার মজুদ শেষ পর্যায়ে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বেশিদিন কয়লা সরবরাহ করা সম্ভব হবে না।

সূত্রমতে, খনির কোল ইয়ার্ডে বর্তমানে দেড় লাখ টন কয়লা মজুদ থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে শনিবার খনির কোল ইয়ার্ডে মজুদ ছিল মাত্র ৪ থেকে ৫ হাজার টন কয়লা। বাকি ১ লাখ ৪০ হাজার টন কয়লার কোনো হদিস নেই।

কয়লার অভাবে বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হওয়ায় পেট্রোবাংলা ও খনি কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পেট্রোবাংলা এক অফিস আদেশে খনির মহাব্যবস্থাপক (মাইন অপারেশন) নুরুজ্জামান চৌধুরী ও উপমহাব্যবস্থাপক (স্টোর) খালেদুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করে।

এছাড়াও ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিব উদ্দিন আহমদকে অপসারণ করে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের দফতরে সংযুক্ত করা হয় এবং মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও কোম্পানি সচিব) আবুল কাশেম প্রধানিয়াকে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড সিরাজগঞ্জে তাৎক্ষণিক বদলি করা হয়। বড়পুকুরিয়া খনির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (অতিরিক্ত দায়িত্ব) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে পেট্রোবাংলার পরিচালক আইয়ুব খানকে।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, কয়লা বিক্রিতে অনিয়মের কারণেই খনিতে কয়লার এ ঘাটতি।

বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের অপসারণ হওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী হাবিবউদ্দীন আহমদ জানান, ১ লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা সিস্টেম লস। তিনি দাবি করেন, গত ১১ বছরে ১ কোটি ১০ লাখ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা সিস্টেম লস। কোল ইয়ার্ড কখনোই খালি না হওয়ায় তারা এ সিস্টেম লস আগে বুঝতে পারেননি।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: