কৃষির গুচ্ছে বাকৃবির ভাবমূর্তি

মতামত
ড. মোঃ সহিদুজ্জামান
দেশের উচ্চশিক্ষায় ভর্তিচ্ছুদের ভোগান্তি ও খরচ কমাতে সাতটি কৃষিভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি শুরু করে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন এই পদ্ধতির যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) প্রথম এটির দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কোন রকম অভিযোগ ও অসংগতি ছাড়াই সফলভাবে এই গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ থেকে শুরু করে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করে। পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরের শিক্ষাবর্ষে (২০২০-২১) গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বশেমুরকৃবি) এই গুচ্ছ পদ্ধতি পরিচালনার দায়িত্ব পায়। সঠিকভাবে ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে ও সমস্যা শুরু হয় প্রবেশপত্র ডাউনলোডের মধ্য দিয়ে। বেঁধে দেওয়া সময়ে যারা প্রবেশপত্র ডাউনলোড করেননি তাঁদের পরিবর্তে পরবর্তী মেধাক্রম থেকে প্রবেশপত্র ডাউনলোডের সুযোগ দেওয়ায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রবেশপত্র ডাউনলোডের ক্ষেত্রে নতুন এই পদ্ধতি প্রয়োগ করায় এবং ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে এ রকম কোনো তথ্য না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী সমস্যায় পড়েছিলেন। এ ছাড়া পরীক্ষার্থীদের তাঁদের ইচ্ছামতো পরীক্ষা কেন্দ্র নির্বাচনের সুযোগ থাকলেও ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কমিটি প্রবেশপত্র ডাউনলোডের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কেন্দ্র ও আসনবিন্যাস সাজিয়েছেন বলে অনেকের অভিযোগ (কালের কন্ঠ ২৪ নভেম্বর, ২০২১ )। তবে আয়োজক কমিটি পরীক্ষার্থীদের বিশেষ কয়েকটি বিষয়ের নম্বরের ভিত্তিতে এই সীট প্লান সাজিয়ে বলে ব্যাখ্যা দিতে শোনা যায়।
এরপর পরীক্ষা গ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হলেও ফল প্রকাশের পর থেকেই এই গুচ্ছভুক্ত ভর্তি পরীক্ষায় নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করেও মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া, তুলনামূলক বেশি নম্বর পেয়েও মেধা তালিকার পেছনের সারিতে নাম আসা এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে অনিয়মের অভিযোগ উঠে। অবশ্য পরীক্ষা আয়োজক কমিটি উত্তরপত্র মূল্যায়নে অনিয়মের অভিযোগ আমলে নিয়ে এক হাজার টাকা ফি সাপেক্ষে উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষার সুযোগ দেয়। এতে প্রথমে প্রকাশিত ফলাফল পরিবর্তন করে নতুনভাবে ফল প্রকাশ করা হয়। এতে মেধাক্রম পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেকেরই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। এ নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা। এছাড়া কোটায় আবেদন করে সাধারণ মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার পরও পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে প্রতিবন্ধী ও প্রবাসী কোটার অনেক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সে সময়।
২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে তিনটি গুচ্ছ পদ্ধতিতে ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করে। এদের মধ্যে কৃষিতে ৭টি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ২০ টি এবং প্রকৌশলে ৩ টি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার পর হওয়ায় অনেকেই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন না। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এসএসসি ও এইচএসসির নম্বরের ভিত্তিতে সিলেকশন করলেও তাদের সিলেকশন অনেক বেশি যেখানে কৃষির গুচ্ছে আসনসংখ্যার মাত্র দশগুন শিক্ষার্থীকে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে সামনের সারির বেশ কিছু শিক্ষার্থী কৃষির কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাথমিকভাবে ভর্তি হলেও তাঁদের বেশির ভাগেই অন্যত্র ভালো কোথাও চলে যেতে দেখা যায়, ফলে বার বার অপেক্ষমান তালিকা থেকে ভর্তির সুযোগ দিলেও আসনসংখ্যা শেষমেষ কিছু খালি থেকেই যায়। যেখানে দেশে উচ্চশিক্ষায় আসনসংখ্যা সীমিত, সেখানে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা কমিটির এমন সিদ্ধান্তের কারণে অনেকেই কৃষিবিদ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা নিঃসন্দেহে অনাকাঙ্ক্ষিত।
কৃষিভিত্তিক এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো (বাকৃবি ও বশেমুরকৃবি বাদে) যদি গুচ্ছতে আসার আগে আবেদনকৃত যোগ্য সব শিক্ষার্থীর জন্য ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে, তাহলে সমন্বিত এই পরীক্ষায় সম্মিলিতভাবে কেন পারবে না তা বোধগম্য নয়। এ ছাড়া দেশের অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজগুলো যদি ভর্তীচ্ছু সব প্রার্থীর জন্য ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে পারে, তাহলে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পারবে না। জায়গা সংকুলান না হলে আবেদন করা সব যোগ্য প্রার্থীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই শিফটে ৫০ শতাংশ করে আসন বণ্টন করে ভিন্ন সেট প্রশ্ন দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে, যেটি করছে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। অথবা আশপাশের বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এমনকি শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে নিজ বিভাগে পরীক্ষা কেন্দ্র করা যেতে পারে।
একজন শিক্ষার্থী শারীরিক বা অন্য কোন কারণে কোন একটি গুচ্ছে অকৃতকার্য হলে ঐ গুচ্ছের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর হাতছাড়া হয়ে যায়। এটি যেমন একজন শিক্ষার্থীর জন্য আতংকের বিষয়, অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি সম্পন্ন করতে লম্বা সময় লেগে যায়। গুচ্ছ পদ্ধতির বিদ্যমান প্রক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে, যাদের জিপিএ অপেক্ষাকৃত কম, তাঁরা আসলেই যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যারা নির্বাচিত হচ্ছেন তারা সব গুচ্ছে নির্বাচিত হচ্ছেন। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেখানে অপেক্ষাকৃত কম জিপিএ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী ভর্তিও সুযোগ পেতেন তা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই সামনের দিনগুলোতে সিলেকশন বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যায় কি না সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষ সদয় দৃষ্টি দেবেন।
কৃষির আসন্ন গুচ্ছ পরীক্ষার (২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ) দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর হয়তবা অন্যান্য কৃষিবিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রোটেশনে দায়িত্ব পাবে। এর আগে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তার নিজস্ব আঙ্গিকে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকত। গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষায় অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে। একসঙ্গে অনেক শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল। তাই যে প্রশ্নগুলো সামনে এসেছে- প্রথমত এই গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা সঠিকভাবে সম্পন্ন করার সক্ষমতা সামনের দিনগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আছে কিনা তা অবশ্যাই গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত অন্যের আংশিক সহযোগিতা নিয়ে এটি সফলভাবে সম্পন্ন করা কতটুকু সম্ভব। এবং তৃতীয়ত সক্ষমতা ছাড়া এভাবে প্রতিবছর এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রায়াল দিতে গিয়ে যদি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের জীবনের ক্ষতি হয় তা কতটুকু সমীচিন হবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ টিম প্রতিবছর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সহযোগিতা করবে এটি যেমন বাস্তবসম্মত নয় তেমনি আংশিক সহযোগিতায় নিছিদ্র নিরাপত্তা, সচ্ছতা ও সফলতা নিশ্চিত করাও কঠিন। এছাড়া এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ টিমের পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা বা পরামর্শ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব হয়ে উঠে না যেমনটি হয়েছিল বশেমুরকৃবি’র ক্ষেত্রে ।
২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছ পদ্ধতির বিভিন্ন ধাপে যে বিষয়গুলো ঘটেছে তার সমালোচনা থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও রেহাই পায়নি। এতে বিশ্ববিদ্যালয়টির ভাবমূর্তি এবং ঐতিহ্য হারানোর বিষয়টি সামনে এসেছে। কারণ সৃষ্টিলগ্ন থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠেনি। যেটি নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয়টির গৌরব ও ঔতিহ্য। এই ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র ধরে রাখতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দুটি পথ খোলা আছে। একটি গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আসা এবং দ্বিতীয়টি যদি গুচ্ছে থাকতে হয় তাহলে পরীক্ষার দায়িত্ব ততদিন ধরে রাখা যতদিন অন্যরা সক্ষমতা অর্জন না করে। বুয়েট তার স্বতন্ত্র বা ঐতিহ্য ধরে রাখতে গুচ্ছে যায়নি বলে জানা যায়।
গুচ্ছের পরিপূর্ণ সুফল পেতে হলে ইতিমধ্যে যেটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে সেটিকে আমলে নিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে শিক্ষাথীদের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং গ্রহণযোগ্যতা হারাবে বহুকাঙ্খিত এই গুচ্ছ পদ্ধতি।
ড. মোঃ সহিদুজ্জামান, লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়