বন‍্যা মোকাবেলায় আগাম পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি

জেবিন তাসমিনঃ

বাংলাদেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে আকস্মিক শুরু হওয়া বন্যার পেছনে শুধু প্রাকৃতিক নয়, আছে অনেক মানবসৃষ্ট কারণ। অসময়ে এ বন্যায় কৃষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, সবমিলিয়ে ৩৫ লাখের বেশি মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়েছে। তাই বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আগাম প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন।

সিলেটে এক মাসে দুইবার এবং সুনামগঞ্জে দুই মাসে তিনবার বন‍্যা হলো। এই আকস্মিক বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ ভারতের মেঘালয়ে প্রাকৃতিক বন উজাড় করে চাষাবাদ। প্রাকৃতিক বন উজাড় হওয়ার কারণে পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই খুব দ্রুত ওই পানি গড়িয়ে নদীতে গিয়ে পড়ছে এবং পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি করছে। এতে প্রচুর পরিমাণে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় হচ্ছে এবং ক্ষয়ে যাওয়া মাটি এসে জমা হচ্ছে সিলেট অঞ্চলের নদ-নদী ও হাওর অঞ্চলে। ফলে নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। অক্ষম হয়ে পড়ছে পানি ধারণ করতে। পানি নদীর পাড় উপচে লোকালয় প্লাবিত করছে। সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা আর এতেই ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা।

নদী ভরাটের পাশাপাশি যত্রতত্র সুইসগেট, বাঁধ, অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের কারণে নদীগুলোর প্রশস্ততাও ধীরে ধীরে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। নদীগুলো নাব্য হারানোর কারণে বন্যা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক আকার ধারণ করছে। এই নদীগুলো এবং সিলেট নগরীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ছড়া ও নালাগুলো দখলমুক্ত করার পাশাপাশি খনন করা গেলে নদীর পানি প্রবাহের স্বাভাবিক পথ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সিলেট অঞ্চলের বেশিরভাগ পানি প্রবাহিত হয় কালনী নদী দিয়ে। অথচ এ নদী পলি জমে ভরাট হয়ে গেছে। নদীটি খনন করে প্রশস্ত করা গেলে বন্যার পানি সহজেই বের হয়ে যেতে পারবে।

বাংলাদেশ ভাটির দেশ হওয়ায় এখানে প্রতিবছরই কম-বেশি বন্যা দেখা দেয়। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নদীর উৎস দেশের ভূ-সীমানার বাইরে। অভিন্ন নদীগুলোর গতি-প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ, বিশেষ করে ভারত ও নেপালের সঙ্গে এমন বাস্তবসম্মত উদ্যোগ নেওয়া উচিত, যাতে তা ফলপ্রসূ হয়।

এদিকে হাওরাঞ্চলে অকাল বন্যায় ব্যাপক ফসলের ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি সহসা পূরণ করা সম্ভব নয়। তার উপর আগাম বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সামনে আমন ধান রোপনের মৌসুম। এ অবস্থায় বড় ধরনের বন্যা দেখা দিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। এমতবস্থায় আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার করা ছাড়া বিকল্প নেই।

আবহাওয়া অফিসকে আরও সতর্ক হয়ে আবহাওয়ার গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করে মানুষকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিতে হবে। এছাড়া ভারতের আবহাওয়া কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত তথ্য বিনিময় করার ব্যবস্থা নিতে হবে। খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলায় উৎপাদনের ওপর যেমন জোর দিতে হবে, তেমনি বন্যা-বৃষ্টি থেকে ফসল, মৎস্য খামার, গবাদিপশু, বাড়িঘর রক্ষার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

গত ৫০ বছরে দেশে প্রচুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি হয়েছে। তবে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে না—এটা একটা বড় সমস্যা। সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব এবং দুর্নীতি রোধ করতে না পারাই এর মূল কারণ। কাজেই কেবল বাঁধ দিলেই হবে না, একইসঙ্গে সেগুলোর সঠিক ব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ নিশ্চিত করতে হবে।

নদী দখল ও দূষণমুক্তকরণ, শাসন এবং বাঁধ নির্মাণসহ সব ব্যবস্থাপনা যদি আমরা একসঙ্গে সঠিক ও দুর্নীতিমুক্তভাবে করতে পারি, তাহলে বন্যার প্রকোপ হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়। তাই অবিলম্বে এ দিকটিতে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া জরুরি।

লেখকঃ শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3