বন্যায় কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি, কৃষকের করনীয়
হালিমা তুজ্জ সাদিয়া:
ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে প্রতি বছরই দেশের কোথাও না কোথাও কম বেশি আকষ্মিক বন্যা দেখা দেয়। বন্যা বর্তমান সময়ে কৃষি খাতে একটি বড় বাঁধা। সম্প্রতি উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে দেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চলমান আকস্মিক এই বন্যায় চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও ময়মনসিংহসহ দেশের ২৪টি জেলায় ৩ লাখ ৩৮ হাজার হেক্টরের বেশি ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি। যেখানে ৪৫ শতাংশের বেশি আমন ধানের ক্ষেত পানির নিচে চলে গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, আকস্মিক এই বন্যায় দেশের ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৯২২ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রধান ফসল হচ্ছে বোনা আমন, রোপা আমন ও আউশ ধান। এ ছাড়া রোপা আমনের বীজতলা, শাকসবজি, আদা, হলুদ, আখ, পান ও কলার বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের এই বন্যা পরিস্থিতিতে কৃষিখাতে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের করনীয় সম্পর্কে লিখেছেন হালিমা তুজ্জ সাদিয়া।
বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকের করণীয়
হঠাৎ বন্যার কবলে পড়ায়, বিভিন্ন জেলায় কৃষিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক। তাই বন্যার এই ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে, বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকদের উপযুক্ত পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে।
ধান চাষের ক্ষেত্রে
১. ধান আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। তাই আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার বন্যাকবলিত এলাকায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী আমন ধানের উৎপাদন নিশ্চিত করা। তা সম্ভব না হলে সবজি ফসলের উৎপাদন বাড়ানো। আমাদের লক্ষ্য যতটা সম্ভব কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা। সেজন্য সব অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে হবে। বন্যা-পরবর্তী সময়ে উঁচু এলাকায় আপৎকালীন নাবী জাতের রোপা আমন বীজতলা তৈরি, ভাসমান বীজতলা তৈরি, স্থানীয় জাতের পরিবর্তে উফশী জাত আবাদ উদ্যোগ নিতে হবে।
২. বন্যা পরবর্তী দ্রুততম সময়ে বীজতলা তৈরির জন্য স্বল্পমেয়াদি রোপা আমন ধানের জাত (ব্রি ধান-৩৩, ৩৯, ৫৬, ৫৭, ৬২,৬৬, ৭১, ৭৫, ৮৭), জলমগ্নতা সহনশীল (ব্রি ধান-৫১, ৫২, ৭৯, বিনাধান-১১, ১২) জাতের বীজ ব্যবহার করতে হবে, নাবী জাতের রোপা আমন- বিআর-২২ (কিরণ) ও বিআর-২৩ (দিশারী) এবং স্থানীয় গাইঞ্জা, আবছায়া, ডাবল ট্রান্সপ্ল্যান্টিং পদ্ধতিতে রোপা আমন চাষ বাড়াতে হবে।
৩. আলোক অসংবেদনশীল এবং স্বল্পমেয়াদী জাত (বিনা ধান-০৭, বিনা ধান-১৬, বিনা ধান-১৭) সরাসরি বপনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৪. বন্যা কবলিত এলাকায়, বীজতলা তৈরি করার মতো জায়গা না থাকলে দাপগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বাড়ির আঙিনায় পলিথিন বিছিয়ে সরাসরি বীজ ঢেলে দিতে হবে। এক্ষেত্রে মাটির প্রয়োজন হয় না। তবে সাধারণ বীজতলার তুলনায় এ পদ্ধতিতে অধিক বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য দিতে হয় এবং নিয়মিত পানি সরবরাহ করতে হয়। এ পদ্ধতিতে ১৫ দিনের মধ্যেই বীজের অঙ্কুরোদগম হবে এবং জমিতে লাগানো যাবে।
৫. বন্যা কবলিত এলাকায়, উঁচু জমির ব্যবস্থা করতে না পারলে- কচুরিপানা ও পানিতে জন্মানো উদ্ভিদ ধাপে ধাপে সাজিয়ে ভাসমান বীজতলা তৈরি করে সেখানে বীজ বপন করতে হবে। এছাড়াও কুশি আলাদাকরণ পদ্ধতির সাহায্যে জমিতে চারা রোপণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৬. ২১-২৫ দিনের চারা এবং ১৫ সেমিx১৫ সেমি দূরত্বে রোপন করতে হবে। এবং অপেক্ষাকৃত বয়স্ক চারা রোপণের ক্ষেত্রে বেশী সংখ্যক চারা (৪-৫ টি চারা/গোছা) ঘন করে ২০ সেমিx১৫ সেমি দূরত্বে রোপণ করা এবং অনুমোদিত মাত্রায় সার প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরপরই সার প্রয়োগ করা ঠিক না, এতে ধান গাছ পচে যেতে পারে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ১০ দিন পর ধানের চারায় নতুন পাতা গজানো শুরু হলে বিঘাপ্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া ও ৮ কেজি পটাশ সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।
৭. রোপা আমন ধানের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে, ভালো জায়গার সুস্থ গুছি থেকে কিছু অংশ তুলে নিয়ে ফাঁকা জায়গা পূরণ করে দিতে হবে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর পরই চারার পাতার ৮-১০ সেন্টিমিটার (৩-৪ ইঞ্চি) আগা কেটে দিতে হবে এবং ছত্রাকনাশক স্প্রে করে দিতে হবে।
৮. বন্যার পরবর্তী সময়ে ধান গাছে মাজরা পোকা, বাদামি ও সাদা পিঠ গাছ ফড়িং, পাতা মোড়ানো এবং পামরি পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য পোকা বিশেষে হাত জাল, পার্চিং এবং প্রয়োজন হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে।
৯. বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য- ধান গাছের যাবতীয় পরিচর্যা যেমন- আগাছা দমন, পোকামাকড় ও রোগাক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা, সুষম পরিমাণে সার প্রয়োগ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পূরক সেচের ব্যবস্থা করতে হবে।
সবজি চাষের ক্ষেত্রে
১. বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের ফসলের যত্ন ও রবি ফসল বিশেষ করে সবজি চাষাবাদ কার্যক্রম যথারীতি চালিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে আগাম জাতের শীতকালীন সবজি উৎপাদনের বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
২. সবজি চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত উঁচু জমি পাওয়া না গেলে- ভাসমান বেডে শাকসবজি আবাদের ব্যবস্থা করতে হবে। এক্ষেত্রে ভাসমান কচুরিপানার ওপর লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া ও অন্যান্য সবজির চারা তৈরি করে সময়ানুযায়ী স্থানান্তর করতে হবে। তাছাড়া বস্তায় লতা ও মসলা (মরিচ, আদা) জাতীয় শস্যের আবাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
৩. বন্যার পানি নেমে গেলে বিনা চাষে গিমাকলমি, লালশাক, ডাঁটা, পালং, পুঁইশাক, ধনে, সরিষা, খেসারি, মাষকালাই আবাদ করা যেতে পারে।
৪. আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলি জমির রস কমানোর জন্য মাটি আলগা করে ছাই মিশিয়ে এবং সামান্য ইউরিয়া ও পটাশ সার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
৫. এ বছর লাগানো সবজির চারার গোড়ার পানি নিষ্কাশনের জন্য নালা করার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে গোড়ায় মাটি দিয়ে সোজা করে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে।
৬. বন্যা পরবর্তীতে চারা গাছ সম্পূর্ণভাবে মাটিতে লেগে যাওয়ার সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতা পোড়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ৬০ গ্রাম থিওভিট ও ৬০ গ্রাম পটাশ সার ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে।
কৃষকের চাষাবাদে সাবধানতা
১. বন্যা পরবর্তী সময়ে চাষাবাদের ক্ষেত্রে কৃষকদের বাড়তি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এসময় ধানক্ষেত কিংবা অন্যান্য জমিতে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে জমিতে চাষাবাদের সময় হাঁটু পর্যন্ত শক্ত বুটজাতীয় জুতা পরা ভালো। এতে করে বিষাক্ত সাপের কামড় থেকে অনেকটাই নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারবেন কৃষকরা।
২. বন্যা পরবর্তী সময়ে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে এম্বুলেন্স, জেলা প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, জেলা কিংবা উপজেলা হাসপাতাল ইত্যাদিতে যোগাযোগ রাখতে হবে।
বন্যা পরবর্তী সময়ে সকলের ক্ষেত্রে করণীয়
১. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন।
২. কৃমিনাশক ঔষধ খান।
৩. বৈদ্যুতিক তার হতে সাবধান থাকুন।
৪. সাপ ও অন্যান্য প্রাণী হতে সাবধান থাকুন।
৫. বিশুদ্ধ পানির ব্যবহার করুন।
৬. ঘরে বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করুন।
৭. খাবার অর্থ্যাৎ শাকসবজি কিংবা ফলমূল ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করুন।
আকষ্মিক বন্যায় কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহন করতে হবে। সরকারি বেসরকারি সংস্থা থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ হাতে নিতে হবে। ফসল চাষাবাদে কার্যকর সময় ব্যবস্হাপনা, নদী ও খাল-বিল খননের মাধ্যমে পানি প্রবাহ সচল রেখে কৃষিখাতে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠিত হবে।