দেশের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট কৃষির গুরুত্ব

স্মার্ট কৃষি দেশের কৃষিপদ্ধতির একটি আধুনিক ব্যবস্থা। স্মার্ট কৃষি বলতে খামারে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ডিভাইস; যেমন—সেন্সর, লোকেশন সিস্টেম, অটোমেশন, রোবটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায়। স্মার্ট কৃষি হলো মূলত বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য অল্প পরিমাণ জমিতে বেশি খাদ্যোৎপাদন। বিশেষ করে এটি প্রাকৃতিক সম্পদ ও কৃষি ডিভাইসগুলোর দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফলন বৃদ্ধি করতে সক্ষম করে তোলে।

স্মার্ট কৃষির তিনটি প্রধান উদ্দেশ্য হলো টেকসই কৃষি উৎপাদনশীলতা ও আয় বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও স্থিতিস্থাপকতা তৈরি, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস অথবা অপসারণ করা। স্মার্ট কৃষির চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো কৃষির আধুনিকায়ন ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে শস্যের গুণগত মান ও পরিমাণ বৃদ্ধি এবং মানবশ্রমকে যথাযথ ব্যবহার করা।

বহুমুখী কৃষিপণ্য উৎপাদন ও কৃষির সাফল্যের জন্য বহির্বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ একটি রোল মডেল। বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের জন্য একটি অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।

এ জন্য দরকার স্মার্ট কৃষির সফল বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট কৃষির গুরুত্ব অনেক। আমাদের দেশের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা প্রান্তিক ধরনের। বাংলাদেশে খাদ্যশস্য চাষের জন্য বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করতে হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাত, বাষ্পীভবন, জলাবদ্ধতা এবং মাটির আর্দ্রতা ভিন্ন ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে। বর্ধিত খরা ছোট এবং প্রান্তিক খামারগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন ঝুঁকিতে ফেলছে, যে কারণে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পরাগায়ণ এবং শস্য উৎপাদনের সময় আর্দ্রতার চাপ বেশির ভাগ ফসলের ক্ষতি করে। এ ধরনের ক্ষেত্রে স্মার্ট কৃষির মাধ্যমে জমির সঠিক তথ্য নিশ্চিত করে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং সব ধরনের সম্ভাব্য কৃষি ঝুঁকি রোধ করা সম্ভব হবে। স্মার্ট কৃষির ফলে স্প্রে অপচয় কমানো থেকে শুরু করে জ্বালানি অর্থনীতির উন্নতি সাধন করা সম্ভব।

কৃষক তাঁদের খামারের খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলো যথাসময়ে করতে পারবেন এবং দূর থেকে রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যমে কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

আমাদের দেশে স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নের অনেক সুযোগ রয়েছে, যার মাধ্যমে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া সম্ভব। যেমন—স্মার্ট কৃষির মাধ্যমে প্রতি একর জমিতে সব ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, উৎপাদন ব্যবস্থাপনা দ্রুততর করা, সরবরাহব্যবস্থাকে স্মার্ট ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ছাড়া চাষাবাদ থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ—সব ক্ষেত্রে স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার; যেমন—রিমোট কন্ট্রোল, অটোমেশন, অপারেটেড রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার, বীজ বপন যন্ত্রের ব্যবহার, ড্রোন ব্যবহার, স্মার্ট সয়েল ময়েশ্চার সেন্সর ব্যবহার, পিএইচ সেন্সর ব্যবহার করে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষিতে ফলন বৃদ্ধি করা সম্ভব। রিমোট সেন্সিং এবং জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও রোগের পূর্বাভাস প্রদান ও দমন ব্যবস্থাপনা, রোবটিকস (ক্ষেত্রবিশেষে) ইত্যাদি ব্যবহারে কম খরচে অধিক ফলন ও স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে নির্দিষ্ট ল্যান্ডস্কেপ চাহিদা মেটাতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি দেওয়ার সময়সূচি এবং সঠিক ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।

স্মার্ট কৃষিকে বাস্তবায়ন করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)সহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন এআই ব্যবহার করলে ফসলের রোগ ও পোকামাকড় শনাক্তকরণ এবং সেগুলো দমন সম্ভব। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত আবহাওয়া, রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বন্যার আগাম বার্তা দিয়ে ফসলকে রক্ষা করবে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত পোকামাকড় ও রোগ থেকে ফসল রক্ষার পূর্বাভাস জানিয়ে ফসলকে রক্ষা করবে। ফলে কৃষকের সময়, খরচ ও ফসল বাঁচবে। এ ছাড়া ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব। মাল্টি-ইউটিলিটি এরিয়াল প্ল্যাটফরমের মাধ্যমে সরাসরি বীজ বপন, সার প্রয়োগ এবং পরাগায়ণ সম্ভব, যা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। ড্রোনভিত্তিক ইমেজিং দ্বারা ফসলের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করে শস্যের ক্ষতি এড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। এটি ফলনসংক্রান্ত তথ্য এবং কীটপতঙ্গের আক্রমণের  পূর্বাভাস নিশ্চিত করবে।

আবার এআইকে কাজে লাগিয়ে ড্রোন ইমেজিং দ্বারা উদ্ভিদের সংখ্যা, উদ্ভিদের উচ্চতা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর ফোকাস করে স্কেলে ক্রপ ফেনোটাইপিং করতে সক্ষম হবে। হাইপার স্পেকট্রাল ইমেজিং উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলোর বিস্তারিত তথ্য দেয়, যা পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে। ড্রোন এবং এআই ব্যবহার করে ভূখণ্ড জরিপের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় স্থানগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া এআই ব্যবহার করে মাটি, জলবায়ু এবং গাছপালার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশদ ধারণা পাওয়া যাবে। ড্রোন ব্যবহার করে নির্ধারিত এলাকায় বীজ ফেলে বনায়ন সম্ভব হবে। ক্লাউড প্রযুক্তি এবং আইওটির মাধ্যমে মাটির পুষ্টির তাৎক্ষণিক নির্ণয় ইন্টেলিজেন্ট সয়েল সেন্সরের (আইএসএস) মাধ্যমে সম্ভব হবে এবং দ্রুত ও সাশ্রয়ী উপায়ে মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, লবণাক্ততার এইচপি এবং মাটির প্রধান পুষ্টি উপাদান বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে ফসল এবং চারণভূমির স্বাস্থ্য নির্ধারণ করা সম্ভব। এটি কীটপতঙ্গ এবং রোগও শনাক্ত করতে পারে। পর্যাপ্ত ডাটা থাকলে কৃষক খাদ্য উৎপাদনের ক্ষতি ও বর্ধিত খরচ রোধ করে সময়োপযোগী লক্ষ্যযুক্ত কৌশল বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবেন।

বর্তমান বিশ্বে জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, আর্দ্রতা কমে যাওয়া, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণ উদঘাটন ও সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। বোরো ধান চাষে অধিক পরিমাণে সেচের প্রয়োজন হয়। বিকল্প প্রযুক্তি ব্যবহার করে বোরো ধানে পানির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা, বিভিন্ন সবজি চাষে ড্রিপ সেচ পদ্ধতি স্থাপন এবং স্প্রিংকলার সেচ পদ্ধতি স্থাপন করা, ঘরে বসে ডিজিটাল সেচ যন্ত্র পরিচালনা এবং মালচিং পদ্ধতির মাধ্যমে জমিতে আর্দ্রতা বৃদ্ধি করার জন্য স্মার্ট সেচ ব্যবস্থার অনুসন্ধান ও অনুশীলন জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় লবণাক্ত, খরা, জলমগ্ন সহিষ্ণু ফসল দ্রুত কৃষকের কাছে পৌঁছানো দরকার। পাহাড়ি অঞ্চলে জিরো টিলেজ পদ্ধতি এবং ফলগাছে মালচিং পদ্ধতি ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া গ্রিনহাউসের মধ্যে বিভিন্ন সবজি সারা বছর চাষ করার উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশে জমির পরিমাণ কমছে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বল্প জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আবাদযোগ্য জমি, চলতি পতিত জমি, স্থায়ী পতিত জমি ও প্রাতিষ্ঠানিক পতিত জমির সর্বশেষ তথ্য জিআইএসের মাধ্যমে সংগ্রহ করে ডাটাবেইস তৈরি করে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা ক্রমান্বয়ে বাস্তবায়ন করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান জমির সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে স্মার্ট ভার্টিক্যাল অ্যাগ্রিকালচার ফার্মিং, স্মার্ট রুফটপ ফার্মিং, পারিবারিক পুষ্টি বাগান ব্যাপকভাবে চালু করা যেতে পারে। স্মার্ট ওয়েব ও মোবাইল অ্যাপস উদ্ভাবন এবং অন্যান্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে সাপ্লাই চেইন সংক্ষিপ্তকরণ, কৃষক এবং ভোক্তার ক্রয়-বিক্রয়ে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ এবং স্মার্ট কৃষি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে সহজ হবে স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়ন।

লেখক : পরিচালক, স্মার্ট অ্যাগ্রিকালচার ও অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

  •  
  •  
  •  
  •