এমপক্স নিয়ে যা জানালেন বাকৃবির গবেষক ড. বাহানুর

নিজস্ব প্রতিবেদক:

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জনস্বাস্থ্যে মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স নিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করেছে। এই এমপক্স সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ও অণুজীববিজ্ঞানী ড. মো. বাহানুর রহমান।

ড. বাহানুর বলেন, এমপক্স রোগটি মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা সৃষ্টি হয়, যা পক্সভিরিডি পরিবারের অর্থোপক্সভাইরাস গোত্রের একটি ডাবল-স্ট্র্যান্ডেড ডিএনএ ভাইরাস। এর ক্লেড-১ ও ক্লেড-২ নামে দুটি ধরন রয়েছে। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এটি ডিম্বাকার ইটের আকৃতিতে দেখা যায়।

এমপক্সের উপসর্গ বিষয়ে এই অনুজীববিজ্ঞানী জানান, এমপক্স আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ফুসকুড়ি, জ্বর, গলাব্যথা, মাথাব্যথা, পেশিব্যথা, পিঠে ব্যথা, দুর্বলতা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়ার মতো লক্ষণগুলো দেখা যায়। ব্যক্তির দেহে ভাইরাসের লক্ষণ ও উপসর্গ সাধারণত এক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয় এবং প্রায় দুই থেকে চার সপ্তাহ স্থায়ী হয়। ফুসকুড়ি একটি চ্যাপ্টা ঘা হিসেবে শুরু হয়ে ফোসকায় পরিণত হয়। চুলকানি বা ব্যথা হতে পারে। ক্ষত হাতের তালু, পায়ের তলা, মুখ, গলা, কুঁচকি, যৌনাঙ্গ ও এর আশপাশে এবং মলদ্বারসহ শরীরের যে কোনো জায়গায় হতে পারে।

এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিউমোনিয়া, কর্নিয়ার সংক্রমণ, ব্যথা বা গিলতে অসুবিধা, বমি, ডায়রিয়া, অপুষ্টি, সেপসিস (শরীরে ব্যাপক প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়াসহ রক্তের সংক্রমণ), মস্তিষ্কের প্রদাহ এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

সংক্রমিত হওয়ার ধরন প্রসঙ্গে অধ্যাপক বাহানুর রহমান বলেন, এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। এমপক্স ভাইরাস ত্বকের ক্ষত, থুথু, লালা, নাকের পানি ও যৌনাঙ্গের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এমনকী কথা বলা, কাশি বা হাঁচির মাধ্যমেও এটি ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির জামাকাপড়, কম্বল, তোয়ালে, খাবারের পাত্র ব্যবহার করলেও ভাইরাসটি সংক্রমিত হতে পারে। এছাড়া বিভিন্ন ছোট প্রাণী যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ সংক্রমিত হলে তাদের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে পশুতে, এমনকি মানুষেও ভাইরাসটির সংক্রমণ ঘটে। মূলত এ রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু, গর্ভবতী নারী, বয়স্কসহ দুর্বল রোগপ্রতিরোধ সম্পন্ন ব্যক্তিরা।

গবেষণাগারে পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (পিসিআর) দ্বারা এমপক্সের ভাইরাল ডিএনএ নমুনা থেকে শনাক্ত করা হয়। নমুনা হিসেবে সরাসরি ক্ষতস্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ক্ষত না থাকলে গলা ও মলদ্বার থেকে নমুনা সংগ্রহ করা যেতে পারে। সাধারণত এমপক্সের আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয় না। আবার অ্যান্টিবডি শনাক্তকরণ পদ্ধতিগুলোও তেমন কার্যকর নয় বলে জানান অধ্যাপক বাহানুর রহমান।

এমপক্স ভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপক্সের বিস্তার রোধ করার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রযোজনে বাড়িতে বা হাসপাতালে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা উচিত। আক্রান্ত প্রাণী যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে বারবার হাত ধোয়া। বিশেষ করে এমপক্স আক্রান্ত ক্ষতস্থান স্পর্শ করার আগে এবং পরে। ক্ষত ঢেকে রাখা এবং মাস্ক ব্যবহার করা। আক্রান্ত ব্যক্তির ত্বক শুষ্ক রাখা। মুখের মধ্যে ঘা হলে নোনা জল দিয়ে ধোয়া। শরীরের ঘা হলে সিটজ বাথ (নিতম্ব পর্যন্ত বসে থাকা), বেকিং সোডা বা ইপসম সল্ট দিয়ে উষ্ণ স্নান করা। যৌন মিলনের সময় কনডম ব্যবহার করা এমপক্স হওয়ার ঝুঁকি কমায়। ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ খেতে হবে।

সবশেষে চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে অধ্যাপক ড. বাহানুর জানান, এমপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে চারদিনের মধ্যে ভ্যাকসিন দেওয়া উচিত। তবে কোনো লক্ষণ দেখা না দিলে ১৪ দিনের মধ্যে ভ্যাকসিন দিতে হবে। বেশকিছু অ্যান্টিভাইরাল-যেমন গুটি বসন্তের চিকিৎসায় ব্যবহৃত টেকোভিরিম্যাট এমপক্সের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে। সম্প্রতি আগস্ট পর্যন্ত ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও কানাডা জুড়ে ‘এমভিএ-বিএন’ নামে এমপক্সের কেবল একটি ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়েছে।

তিনি জানান, ‘এমভিএ-বিএন’ সাধারণত ২৮ দিনের ব্যবধানে দুটি মাত্রায় দেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনে আরও তিনটি ভ্যাকসিন রয়েছে। এগুলো হলো জাপানের এলসি-১৬, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার ‘এসিএএম-২০০০’ এবং রাশিয়ার ‘অর্থোপক্সভ্যাক’। এগুলোর সবই মূলত প্রস্তুত করা হয়েছিল গুটিবসন্ত ও অর্থোপক্স গোত্রের অন্যান্য ভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে। তবে এককভাবে এমপক্সের ভ্যাকসিন এখনো গবেষণাধীন।

 

  •  
  •  
  •  
  •