পাঙ্গাস-তেলাপিয়া চাষে কোটিপতি

যশোর সংবাদদাতা:
যশোরের মাছের রাজধানী হিসেবে খ্যাতি পেয়েছে চাঁচড়া। এই এলাকার প্রায় প্রত্যেকটি পরিবার মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত। এখানকার মানুষ মাছ চাষে স্বাবলম্বী। মৎস্য পল্লীর বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বাবু ১০ হাজার টাকার পুঁজি নিয়ে তেলাপিয়া মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। ১৬ বছরের ব্যবধানে তিনি কোটিপতি হয়েছেন। অপর একজন মাছ চাষী আতিয়ার রহমান টুলু। তিনি আড়াই হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে পাঙ্গাস মাছের চাষ শুরু করেন। ১৫ বছরে তিনিও কোটিপতি হয়েছেন। সফল দুই মাছ চাষীর সংগ্রাম আর সফলতার গল্প তুলে ধরা হলো।

নুরুল ইসলাম বাবু:
১৬ বছর আগে দশ হাজার টাকা পুঁজিতে এক বিঘা আয়তনের পুকুরে তেলাপিয়া মাছ চাষ শুরু করেন নুরুল ইসলাম বাবু। বর্তমানে একশ বিঘা আয়তনের পুকুরে তেলাপিয়ার চাষ হচ্ছে। আর দশ হাজার টাকার পুঁজি বেড়ে কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সংসারের অভাব অনটন দূর হয়েছে। সংসারে ফিরেছে স্বাচ্ছন্দ্য। এলাকার মানুষের কাছে একজন সফল মাছ চাষী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া এলাকার নূরুল ইসলাম বাবু। অষ্টম শ্রেণির পাঠ চুকিয়ে বাবার সঙ্গে মাছ চাষ শুরু করেন তিনি। সফলতাও আসে।

আতিয়ার রহমান টুটুল বলেন, তার খামারের উৎপাদিত পাঙ্গাসের পোনা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন ময়মনসিংহ, বরিশাল, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ভোলাসহ অন্তত ৩০টি জেলায় সরবরাহ করা হয়। এসব এলাকার মৎস্য চাষী ও ব্যবসায়ীরা ট্রাক-পিকআপসহ বিভিন্ন পরিবহণের ছাদে করে নিয়ে যান। আগামী আশ্বিন মাস পর্যন্ত এসব মাছের পোনা বিকিকিনি চলবে।

মৎস্য চাষী আতিয়ার রহমান টুটুলের এ সফলতা দেখে জেলার অন্যান্য মাছ চাষীরাও এখন পাঙ্গাস চাষের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন। চাঁচড়ার মৎস্য চাষী এসকে রাব্বুন আপ্পি বলেন, তিনি কই, শিঙ, মাগুরসহ অন্যান্য মাছের চাষ করতেন। পাঙ্গাস মাছ অনেকটা লাভজনক হওয়া তিনি এ মাছের চাষ শুরু করেছন।

যশোর সদর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনিসুর রহমান জানান, গত কয়েক বছরে এ জেলায় পাঙ্গাসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের অন্যান্য জেলায় পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদন হলেও গুনগত মানের দিক থেকে যশোরের মাছের চাহিদা বেশি।

যশোর জেলা মৎস অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক আক্তার উদ্দীন জানান, এ অঞ্চলে মাছের উৎপাদন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যশোর জেলায় প্রতিবছর তোলাপিয়া মাছ উৎপাদন রয়েছে ১৮ হাজার ২৭৪ মেট্রিক টন। দেশের অন্যান্য জেলার তোলাপিয়া উৎপাদন হলেও গুণগত মানের দিক থেকে যশোরের মাছের চাহিদা বেশি। যে কারণে দিন দিন এ মাছের চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এর তিন বছর পর ২০০০ সালে নিজেই নেমে পড়েন তেলাপিয়া চাষে। এরপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে ব্যবসায় উন্নতি হয়েছে। ফিরেছে নিজের ভাগ্য। জমি কিনে বাড়ি করেছেন। বৃদ্ধি করেছেন পুকুরের আয়তন। বেড়েছে পুঁজিও। তার সফলতার গল্প এলাকার মানুষের মুখে মুখে। তাকে দেখে অনেকে আগ্রহী হচ্ছেন মাছ চাষে।

নুরুল ইসলাম বাবু বলেন, মাছ চাষ করে ৪০ লাখ টাকায় জমি কিনে ছয় কক্ষের পাকা বাড়ি করেছি। বাড়ি করতে খরচ হয়েছে ২০ লাখ টাকা। বর্তমানে একশ বিঘা জমিতে তেলাপিয়া মাছ চাষ করছি। পুকুর ইজারা ও মাছ চাষে প্রায় ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছি। এছাড়াও স্বাচ্ছন্দ্যে চলছে সংসার। দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে নবম শ্রেণি আর মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।

তিনি বলেন, তার শাহ্ আলী মৎস্য খামারে নিয়মিত-অনিয়মিত ২০ জন কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এছাড়াও সফলতা দেখে নূর আলম, মিন্টুসহ অনেক বেকার যুবক তেলাপিয়া মাছ চাষ শুরু করেছেন। তোলাপিয়া মাছ চাষে সফলতা অর্জন করায় জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০১৫ উপলক্ষে তিনি সম্মাননাও পুরস্কার পান।

মাছ চাষ শুরু প্রসঙ্গে নুরুল ইসলাম বাবু জানান, ১৯৯৭ সালের দিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে বাবার সাথে মাছ চাষে যোগ দিই। নিজেদের কোন জমি না থাকায় অন্যের পুকুর লিজ নিয়ে বাবা মাছ চাষ করতেন। আমি ছিলাম ভাই বোনদের মধ্যে বড়। বাবার একমাত্র আয়ে সংসার চলে না। তাই অষ্টম শ্রেণির পর আর লেখাপড়া করা হয়নি। লেখাপড়া ছেড়ে বাবার সাথে মৎস্য খামারে কাজ শুরু করি। মাছ চাষে সফলতাও আসে। সংসারের অভাব কিছুটা লাঘব হয়। ২০০০ সাল আমার কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় পারিবারিকভাবে আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়। নতুন সংসার। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। বাবার সাথে পরামর্শ করে এক বিঘার একটি পুকুর লিজ নিই। তখন আমার পুঁজি মাত্র ১০ হাজার টাকা। এই ১০ হাজার টাকা আমার ভাগ্য খুলে দিয়েছে।

নুরুল ইসলাম বাবু বলেন, প্রথম বছরই তেলাপিয়া চাষ করে তার তিন লাখ টাকা লাভ হয়। এরপর ২০০৫ সালে তিনি আরো দুইটি পুকুর লিজ নেন। বর্তমানে তিনি শাহ আলী মৎস্য খামারের আয়তন আরো বাড়িয়েছেন। গত বছর ১০০ বিঘা আয়তনের ৯টি পুকুরে তেলাপিয়া চাষ করে তার লাভ হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা। তার প্রত্যাশা এ বছর তার নীট আয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

আতিয়ার রহমান টুলু:
দুই হাজার পাঁচ শত টাকার পুঁজি নিয়ে মাছের ব্যবসা শুরু করেন যশোর সদরের চাঁচড়া এলাকার বাসিন্দা আতিয়ার রহমান টুলু। ২০০০ সালে জেলার শার্শার উপজেলার গয়ড়া গ্রামে মেহেদি হাসান আলীর কাছ থেকে ৭ বিঘা জমির ওপর নির্মিত পুকুর লিজ নিয়ে বিভিন্ন জাতের মাছের পোনা চাষ শুরু করেন তিনি। এরপর থেকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। বর্তমান তিনি ১৯৫ বিঘা পুকুরে পাঙ্গাসের পোনা চাষ করে সাফল্যর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ‘জলের সোনা’ মৎস্য প্রজেক্ট নামে মৎস্য খামার থেকে ২০১৬ সালে ৫ কোটি টাকার পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদন করেছেন। উৎপাদিত এসব পোনা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্যে প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। পাঙ্গাস মাছ চাষে নিরব বিপ্লব সৃষ্টি করেছে মৎস্য চাষী আতিয়ার রহমান টুটুল।২৬ হেক্টর জলাশয়ে বছরে প্রায় ৫ কোটি পাঙ্গাসের পোনা উৎপাদন করে নজীর স্থাপন করেছেন। তার দেখাদেখি এলাকার অনেকেই এখন পাঙ্গাস মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।

মৎস্য চাষী আতিয়ার রহমান টুটুল বলেন, তিনি এর আগে রুই, কাতল, মৃগেলসহ অন্যান্য দেশি জাতের মাছের পোনারচাষ করতেন। ৭ বছর আগে তিনি পাঙ্গাস মাছের পোনা চাষ করেন। পাঙ্গাস মাছের চাহিদা স্থানীয় বাজারে বেশি হওয়ায় তিনি লাভের মুখ দেখতে পান। মাছ চাষের সফলতার জন্য তিনি ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৬ সালে জেলা মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৎস্য চাষীর স্বীকৃতি পান।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: