জীবিকা সংকটে ঋষিপল্লীর কারিগররা
নিউজ ডেস্কঃ
এক দশক আগেও যশোর সদর উপজেলার নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের রূপদিয়ার চাউলিয়া ঋষিপল্লীতে কাক ডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলত বাঁশের বিভিন্ন পণ্য তৈরির কাজ। পুুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে সমানভাবে সহযোগিতা করতেন।
কিন্তু বাজারে প্লাস্টিক পণ্যের দৌরাত্ম্য, পুঁজি ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে হারাতে বসেছে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন শৌখিন পণ্য। তার পরও বাপ-দাদার এ পেশা আগলে ধরে কোনো রকম পরিবার নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন এ পল্লীর বাসিন্দারা। কিন্তু দেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর থেকে আদতে বন্ধ হয়ে গেছে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জাম বিক্রি। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে চরম সংকটের মধ্যে রয়েছেন তারা।
জানা গেছে, রূপদিয়ার চাউলিয়া ঋষিপল্লীর বাসিন্দারা বাঁশ-বেতের তৈরি চাটাই, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরি বা ঝুড়ি, পোলো, ডোল (ধান রাখার পাত্র), চালুনি, মাছ রাখার খালই, হাঁস-মুরগি রাখার খাঁচা ও টেপারিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করতেন। কালের বিবর্তনে এসব বাঁশের তৈরি পণ্যের স্থান দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক পণ্য। এমনিতে মানবসভ্যতার পরিবর্তন, তার ওপর মহামারীর আগ্রাসন সব; মিলিয়ে কোনোমতে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চলের হস্তশিল্পীরা। দীর্ঘ সময়ের মহামারী ভাইরাসে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি ও উপকরণের মূল্য বাড়াসহ প্লাস্টিক পণ্যের সহজলভ্যতায় এ অঞ্চল থেকেও বাঁশ শিল্প বিলুপ্তির পথে। বলা চলে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গ্রামবাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁশ শিল্পের ঠিকানা এখন জাদুঘরে।
কালাচান দাস নামে বাঁশ-বেতের কারিগর জানান, ১০ বছর আগেও রূপদিয়ার চাউলিয়া পল্লীর বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র উপায় ছিল বাঁশ-বেতের তৈরি হস্তশিল্প। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রতিদিনই চলত গ্রামীণ এ পল্লীজুড়ে বাঁশের চটা দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরির প্রতিযোগিতা। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে শামিল হতেন কাঁধে কাঁধ রেখে। প্রতি সপ্তাহের হাটবারগুলোয় আশপাশের অঞ্চলের স্থানীয় বাজারে পসরা সাজিয়ে চলত বেচাকেনা। অনেকেই আবার বিভিন্ন অঞ্চলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেরি করে বিক্রি করতেন নিজেদের তৈরি বাঁশ-বেতের এসব পণ্য। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এ শিল্পের মূল উপকরণ বাঁশের মূল্যবৃদ্ধিতে বাঁশ-বেতের কারিগররা তাদের পেশা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার ওপর করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে কোনো পণ্যই বিক্রি হচ্ছে না। ফলে বেকার হয়ে পড়েছেন গ্রামীণ এ বাঁশ-বেতের কারিগররা। অনেকেই আবার এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য পেশায়।
কারিগর শিবচন্দ্র রায় জানান, একসময় এসব এলাকার বিভিন্ন জনপদে বড় বড় বাঁশ বাগান দেখা গেলেও এখন আর চোখে পড়ে না। এ বাঁশ দিয়েই বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করে আমরা জীবিকা নির্বাহ করতাম। নির্বিচারে বাঁশ বাগান ধ্বংসের কারণে বাঁশের বংশ বিস্তার কমেছে। একে তো প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছিলাম না। তার ওপর এসে আঘাত করল করোনাভাইরাস। বিক্রি না থাকায় এখন আমি ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চালাচ্ছি।
কারিগর কার্তিক চন্দ্র দাস বলেন, বাঁশের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র মানুষ এখন আর আগের মতো ব্যবহার করছে না। কারণ বর্তমানে প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি পণ্যের ওপর ঝুঁকছে মানুষ। ফলে এ শিল্প চিরতরে হারিয়ে যেতে বসেছে। বাঁশ-বেত শিল্পের দুর্দিন কাটিয়ে সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বাঁশ-বেতে তৈরি জিনিসের স্থানীয় পাইকারি ক্রেতা আনন্দ দাস বলেন, একসময় প্রতিটি বাড়িতেই বাঁশের তৈরি জিনিসপত্রের ব্যবহার ছিল। চাহিদাও ছিল ব্যাপক। আমরা এখান থেকে কিনে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করি। বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প।
এলাকার বাঁশ শিল্পের কারিগর প্রভাষ দাস ও জগদীশ দাস বলেন, কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ায় আমরা এখন অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করছি। শত প্রতিকূলতার মধ্যে পুরনো পেশা ধরে রাখতে সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রয়োজনীয় পুঁজি আর উপকরণের অভাবে সে প্রচেষ্টা থমকে গেছে। আমরা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থার ঋণসহায়তা ব্যবস্থা কামনা করছি। তা না হলে যে ক’জন এ পেশায় টিকে আছেন, তারা আর টিকবেন না। বাধ্য হয়ে পেশা পাল্টাবেন।
নরেন্দ্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোদ্দাসের হোসেন জানান, আগে রূপদিয়ার ঘরে ঘরে ছিল বাঁশ-বেতের কাজ। কারিগররা দিন-রাত পরিশ্রম করে সব জিনিসপত্র বানাতেন। কিন্তু এখন অনেকে পেশা বদল করেছেন। কারণ এ ব্যবসা আর আগের মতো নেই। তার ওপর করোনায় সবার অবস্থা খারাপ। আমরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে খাবার সরবরাহ করেছি। সরকারের সহযোগিতা ছাড়া এ খাতের হস্তশিল্পীরা টিকে থাকতে পারবেন না।