লালমনিরহাট কৃষকের ঘরে ঘরে আগাম নবান্ন উৎসব

লালমনিরহাট সংবাদদাতা:
কয়েক বছর আগেও আশ্বিন-কার্তিক মাস উত্তরের ৮ জেলার মানুষদের জন্য ছিল অভাবের মাস। অভাবের দিনগুলোতে এই এলাকাকে মঙ্গা এলাকা হিসেবে বিবেচিত করা হত। এ সময়ে এই এলাকার অনেক মানুষ থাকত অর্ধাহারে-অনাহারে। ভাতের বিকল্প হিসেবে কচুর মুড়া ছিল তাদের প্রধান খাবার। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। এখন আর এই এলাকার মানুষরা অভাবের সময় কচু ঘেচু খায় না। মঙ্গা তাড়াতে এই এলাকার কৃষকরা আগাম জাতের আমন ধান চাষ করছে।

আমন ধান উঠতে আরো প্রায় এক মাস দেরী থাকলেও লালমনিরহাট সহ উত্তরের রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় কৃষকদের ঘরে ঘরে এখন নবান্ন। আগাম জাতের ধান আবাদ করায় এক মাস আগেই তারা ঘরে তুলছে সোনালী ধান। সেই সাথে ওই জমিতে আগাম আলু, সরিষা, গমসহ বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি আবাদ করে তারা অধিক লাভবান হচ্ছে।

উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলা দিন দিন খরা প্রবণ হয়ে উঠছে। এখানকার অধিকাংশ কৃষক আমন ধান আবাদে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। মৌসুমী জলবায়ুর কারণে বর্ষা মৌসুমে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। আর এই বৃষ্টিকে কাজে লাগিয়ে কৃষকরা অনায়াসেই আমন ধানের আবাদ করত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে প্রকৃতি মানুষের কাছ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এখন আর আগের মত বৃষ্টি হয় না। সামান্য বৃষ্টিতে লাগানো ধান মাত্র এক সপ্তাহের প্রচন্ড খরার মুখে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ প্রতিকূল অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ব্রি ও আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট-ইরি খরা সহিষ্ণু দুটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এগুলো হলো ব্রি ধান-৫৬ ও ব্রি ধান-৫৭। অন্যান্য আমন ধান যেখানে ৭/৮ দিনের খরা সহ্য করতে পারে না সেখানে এ জাতের ধান ২৭ দিন পর্যন্ত খরা সহ্য করতে পারে। ১১০ থেকে ১১৫ দিনের মধ্যে এই ধান কাটার উপযোগী হয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ফলন আসে প্রায় ৪ টনের মত। পোকা মাকড় আক্রমণের আগেই এই ধান কাটা শেষ হয়ে যায়। আবার এই ধান কেটে দ্রুত ওই জমিতে আলু, গম, সরিষা, তিল, তিষিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ করা যায়।

এবার লালমনিরহাট জেলায় বর্ষা মৌসুমের শুরুতে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় অধিকাংশ কৃষক আগেভাগেই জমিতে চারা রোপন করতে পেরেছিল। মৌসুমের মধ্যভাগে এসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কম থাকলেও মৌসুমের শেষে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত কৃষকের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছিল। কঠোর পরিচর্যা এবং সময়মত সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করায় এবার ফলনও আসছে বেশ ভাল। প্রতি বিঘায় ফলন পাওয়া যাচ্ছে ১২ থেকে ১৮ মণ পর্যন্ত। এ কারণে কৃষকরা মান্ধাতা আমলের পাইজাম, লোহাজাং, কলমসহ বিভিন্ন জাতের ধান আবাদ বাদ দিয়ে এই ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছে।

প্রবাদ ছিল ‘অগ্রহায়ণের আট, যেখানে মন সেখানে ধান কাট’ এর অর্থ অগ্রহায়ণ মাসের ৮ তারিখের পর ক্ষেতের আমন ধান পাকবে। তার পরই কাটা যাবে এই ধান। কিন্তু এখন আর আমন ধান কাটার জন্য অগ্রহায়ণ মাসের অপেক্ষা করতে হয় না। কার্তিকের শুরু থেকেই আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হলেও কার্তিকের শেষে এসে পুরো ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে গেছে।

জেলার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কৃষক-কৃষাণীরা এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন নতুন ধান কাটা ও তা বাড়িতে আনার জন্য। যারা বেশি জমিতে এই ধান আবাদ করেছেন তারা মেশিন দিয়ে ধান মাড়াই করছেন। তাই ধান মাড়াই মেশিন মালিকরাও এখন ব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন। অনেক কৃষক আবার নতুন ধান কেটে মাড়াই করে কাঁচা গাছ গো-খাদ্য হিসেবে বিক্রয় করে অধিক লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু এত কিছুর পরও হাসি নেই কৃষকের মূখে। প্রতি মন ধান উৎপাদন করতে যেখানে খরচ হয় ৭শ টাকার উপরে সেখানে নতুন ধান বাজারে বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৬শ টাকা দরে।

জেলার লালমনিরহাট, মহিশখোচা, রাজপুর, খুনিয়াগাছ, গোকুন্ডা বেশ কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিমণ নতুন ধান বিক্রি হচ্ছে ৬শ টাকা থেকে সাড়ে ৭শ টাকার মধ্যে। ধার দেনা করে ধান আবাদ করে ঋণ পরিশোধ করতে তারা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার খাদ্য সংগ্রহ অভিযান শুরু না করা পর্যন্ত ধানের দাম আর বাড়বে না।

লালমনিরহাট মোগলহাটের এলাকার কৃষক আব্দুল লতিফ জানান, এবার তিনি আগের সব জাতের ধান বাদ দিয়ে শুধুমাত্র পারিজাত জাতের ধান আবাদ করেছেন। ইতিমধ্যে এই ধান কাটা শুরু করেছেন। প্রতি বিঘা জমিতে গড়ে ফলন আসছে প্রায় ১৫ মণ করে। যেখানে অন্যান্য জাতের ধান আবাদ করে পেতেন বিঘা প্রতি মাত্র ৮ থেকে ১০ মণ। প্রতি মণ ধানের দাম ৭শ টাকার কম হলে উৎপাদন খরচ উঠবে না।

লালমনিরহাট কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সাফায়েট আলী বলেন, লালমনিরহাট জেলার অধিকাংশ কৃষকই এখন আগাম জাতের ধান আবাদ করছেন। কম সময় এবং অধিক ফলনের কারণে কৃষকরা এই জাতের ধান আবাদে আগ্রহী হচ্ছেন। কৃষি বিভাগের কর্মীরাও কৃষকদের এই জাতের ধান আবাদে উদ্বুদ্ধ করছেন। তিনি বলেন, নতুন ধান বাজারে আসলেও এখনো বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা ধান কিনতে আসেনি। এ কারণে দাম কিছুটা কম। তবে পুরো মৌসুম শুরু ও সরকারিভাবে ক্রয় অভিযান শুরু হলে দাম আরো বেড়ে যাবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: