কৃষকের দুর্দশা এবং কিছু বিকল্প ভাবনা

ড. মোঃ সাইদুর রহমান

ইদানিং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ধানের দাম, উৎপাদন খরচ, কৃষকের ক্ষতি, ধান রপ্তানী করা, আমদানি ঠেকানো, চালের বাজারের কৃত্রিম সিন্ডিকেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত লাভ কমানোর ব্যবস্থা করা, ধানের ক্ষেতে আগুন, মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ, তাঁকে কিছুটা সমর্থন, এমপির উদ্যোগে সরাসরি ধান ক্রয়, ইউএনও কর্তৃক হাটে গিয়ে সরকার নির্ধারিত দামে ধান ক্রয় করা, জেলা প্রশাসক কর্তৃক কৃষকের ধান কেটে দেয়া, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী ও স্কাউটদের সেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কৃষকের ধান কেটে দেয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার তীর ছোড়া, সরকারের আশুকরনীয় ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর লেখালেখি হচ্ছে।

অন্যান্যদের মত আমারও কোন সন্দেহ নেই যে বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। প্রকাশিত সূত্র মোতাবেক ধানের বর্তমান মনপ্রতি বাজরদর ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা যা একজন শ্রমিকের একদিনের মজুরি ৭০০/৮০০ টাকা থেকে অনেক কম। এর সাথে আবার একবেলা খাবার খরচ ন্যূনতম ৩০/৪০ টাকা যোগ করলে কমের পরিমান আরও বেড়ে যায়। ফলশ্রুতিতে ধান চাষ করে ইদানিং কৃষক বর্ননাতীতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যারা আমাদের অন্ন যোগায় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন এটা শুনে সবারই খারাপ লাগে। অনেকে হয়ত প্রতিবাদী হয়ে বলবেন না এটা চলতে দেয়া যায় না। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এটা চলে আসছে এবং তার কারনও রয়েছে বহুবিধ। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ধান উৎপাদন ঘাটতি কোনভাবেই কাম্য নয়। এভাবে চলতে থাকলে ধান উৎপাদনের পরিমান কোন এক সময় অস্বাভাবিকভাবে কমে যেতে পারে। আর তাই যদি হয় ফলাফল কিন্তু সহজেই অনুমেয়।

ধান চাষীদের সম্ভাব্য বিবেচ্য বিষয়াবলী কি কি হতে পারে তার একটি তালিকা করা এবং তাদের দীর্ঘদিনের দুর্দশা কমানোর জন্য কি কি বাস্তব পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে সে বিষয়গুলো বিশ্লেষন করা যাক।

সরকার বেশী করে ধান ক্রয় করতে পারে কি না এবং সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ক্রয় করতে পারে কি না? আমাদের একটু চিন্তা করা দরকার সরকারের খাদ্য দ্রব্যের সংরক্ষন করার সক্ষমতা কতটুকু আছে। ধান-চাল সংরক্ষনে বেশ জায়গার প্রয়োজন এবং এটির সংরক্ষনে কোন ক্রটি হলে তা নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। অসাধু জনবল তো সুযোগের সন্ধানে আছেই। খাদ্য মন্ত্রনালয়ের তথ্য মোতাবেক দেশে বর্তমানে ধান-চাল-গম সংরক্ষনের নিমিত্ত সরকারী গুদামের ধারন ক্ষমতা ২১ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমান মজুদ আছে ১২ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন। এবছর ক্রয় করার টার্গেট ১৩ লাখ মেট্রিক টন যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যতিত অতিরিক্ত আরও ক্রয় কোনভাবেই মঙ্গলজনক হবে না এটা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।

আমদানী বন্ধ বা আমদানী শুল্ক বাড়ানোতে কি কৃষক উপকৃত হবে? রপ্তানি করলে কি কৃষক উপকৃত হবে? না কি সাধারণ ভোক্তারা উপকৃত হবে? সরকার খুব দ্রুত সারা দিয়ে চাল আমদানীতে শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৫৫ শতাংশ করেছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা স্থানীয় বাজার থেকে বেশি দামে ধান ক্রয়ের মাধ্যমে বাজারে চাল সরবরাহ করতে বাধ্য হবে। সমস্যা হল এখানে আবার সিন্ডিকেট হলে সাধারণ ভোক্তারা ক্ষতির স্বীকার হবে। অপরাজনীতির প্রভাব যে এখানে কাজ করবে না তা কিন্তু দিব্য করে বলা য়ায় না। সেই সিন্ডিকেট ভাংগার দায়িত্বও আবার সরকারের উপর বর্তায়। অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক আবার মৌসুম পরবর্তী সময়ে চাল ক্রয় করে জীবন যাপন করে। এটাও মাথায় রাখা দরকার। তবে চাল আমদানীর ক্ষেত্রে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহন আগে কখনই পরিলক্ষিত হয়নি যা খুবই ইতিবাচক।

মৌসুমে ধানের বাজার কম হওয়ার কারন কি? তা নিরসনে কি কি করা যেতে পারে? কৃষকের কিছু করার আছে কি না? ধানে আগুন দেয়াটাই কি সমাধান? অনেকেই হয়তো জানেন অর্থনীতি শাস্ত্রেও জনক এ্যাডাম স্মীথের অদৃশ্য হাতের কথা অর্থাৎ অদৃশ্য শক্তির কারনে বাজারে চাহিদা ও যোগানের ভারসাম্য হয় এবং দ্রব্য সমাগ্রী উৎপাদক থেকে ভোক্তার নিকট পৌঁছায়। আর এ অদৃশ্য বাজার শক্তির মধ্যে সকল মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের অবস্থান এবং তাদের নিকট প্রযুক্তি ও তথ্যের যোগান বেশি থাকে বিধায় চাইলেই তাদের প্রভাব উপেক্ষা করা যায় না। আমাদের দেশের প্রান্তিক চাষীরা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কারনে ধার করা অর্থ ও উৎপাদন খরচ ধান কাটা পর পরই তা বিক্রি করে নির্বাহ করার চেষ্টা করে। কিন্তু সকল কৃষক যখন একই পন্থা অবলম্বন করে তখন বাজারে সরবরাহ এত বেড়ে যায় যার সুবিধা ব্যবসায়ীরা নেয় এবং ক্রয় করতে অনিহা দেখায় ফলে দাম পড়ে যায়। তারাও অপেক্ষা করতে থাকে এই সময়ের জন্য। পূর্নপ্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থার অস্তিত্ব বিরল হলেও আমরা কেবল আমাদের দেশে ধানের বাজারেই এর উপস্থিতি কিছুটা দেখতে পাই। মৌসুম নির্ভর যে কোন কৃষি পণ্যেও প্রকৃতিতে এমন বৈশিষ্ট্য মোটেও নতুন নয়। এক থেকে দুই মাসের ব্যবধানে এ অবস্থা নিশ্চয়ই থাকবে না। এসময়ে তাদেরকে সেই ব্যবসায়িক ধারনা এবং কিছু সহজ পদ্ধতির ঋণ সুবিধা দিতে পারলে তারা উৎপাদিত ধান কিছুদিন ধরে রাখতে পারতো এবং ভাল দাম পেতে পারতো। ধানে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা এবং কোথায় পুড়ানো হয়েছে তা নিয়ে ধোঁয়শা তৈরি হয়েছে। টাংগাইল না বগুড়া না পাঞ্জাবে এটা আসলে কোন বিষয় নয়। আসল বিসয় হচ্ছে কৃষক ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে এবং সে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া। যাতে তাদের ক্ষতি কিছুটা লাগভ করা য়ায় বা তাদেরকে কিছুটা স্বস্তি দেয়া যায়। প্রসংগক্রমে বলে রাখা ভাল, সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে জনপ্রতিনিধি বা কোন সরকারী কর্মকর্তার বাজার থেকে বেশি দামে ধান কিছু ক্রয় করা ফলপ্রসূ কোন পদক্ষেপ নয় বরং এতে সার্বিক বিশংখলা বেড়ে যেতে পারে।

সামাজিক সচেতনায় কি কি অর্জন হতে পারে? তার মাধ্যমে কি আমরা কৃষকদেরকে উপকারী কোন তথ্য বা পরামর্শ দিতে পারি যা তাদের প্রকৃত উপকারে আসবে? প্রাচীনকালে মানুষ পরস্পরের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতো। বর্তমানে প্রচার মাধ্যমের বিস্তৃতি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকায় দ্রুত সংবাদ ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়। স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ধান কেটে দিয়ে কৃষককে উপকার করার পাশাপাশি তাদেরকে যুক্তিসহ তথ্য দিলে কৃষক তা নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে ধীরে ধীরে পরিবর্তন সাধন করতে পারবে, পারবে নিজেদের মত করে নিয়ে তা গ্রহন করতে। কৃষকের চিরায়ত সংস্কৃতি/প্রথা পরিবর্তনে এবং তার গতিময়তা বৃদ্ধিতে প্রচার মাধ্যমও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে এবং প্রচার মাধ্যম তা করেও যাচ্ছে।

কি কি করলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে? কি পদক্ষেপ নিলে শ্রমিকের দাম কমে যাবে? বিকল্প কি পদক্ষেপ নিলে খরচ কমতে পারে? যারা শ্রম বিক্রি করে তারা কারা? ভুমিহীন এবং প্রান্তিক চাষীদের মধ্য থেকেই শ্রম সরবরাহ হয়। কোন কোন অঞ্চল থেকে শ্রমের যোগান বেশি পাওয়া যায়। লক্ষনীয় বিষয় হলো শ্রমের মূল্য বৃদ্ধির কারনে কৃষক ভাইয়েরা কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারে অধিক মনোযোগী হচ্ছেন। কৃষির অনেক ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার হলেও শস্যকর্তনে যন্ত্রের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম। হালে কিছু কম্পানী ও প্রকল্পের অবদানে কম্বাইন হার্ভেস্টারের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এটা ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই কম। চাষীর অথনৈতিক অবস্থার কারনেই বড় যন্ত্রপাতি ব্যবহার সীমিত কিন্তু ছোট যন্ত্র কৃষকের জন্য মোটেও খরচ সাশ্রয়ী নয়। ফলে সেগুলো ব্যবহারে খরচ খুব একটা কমে না। তাই বড় যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন। এক সময় মনে করা হয়েছিল যন্ত্রের আমদানী ও ব্যবহার বাড়লে দরিদ্র শ্রেনির মানুষ বেকার হয়ে যাবে কিন্তু এটা যে সত্য নয় তা আজ প্রমানিত হয়েছে। বরং সত্য হলো যন্ত্রের ব্যবহার মানুষকে আরো কর্মক্ষম করেছে এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করে মানব শ্রমের আরও বেশি মূল্য পেতে সহায়তা করেছে এবং ভবিষ্যতে কৃষিতে প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্রাপাতির ব্যবহারের ফলে শ্রমিকের দক্ষতা এবং শ্রম মূল্য দুটোই বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে হয়। সে সময় আর বেশি দূরে নয় যখন কৃষক ভাইয়েরা তাঁদের মোবাইলে এ্যাপ ব্যবহার করে উবার এবং লিফ্ট এর মত কৃষি যন্ত্রপাতি ধার করে ব্যবহার করবে। কৃষি যন্ত্রপাতির সেবা সে পর্যায়ে যেতে আমাদের খুব বেশি ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হবে না। উন্নত দেশে এটার ব্যবহার হচ্ছে এবং আমাদের দেশেও কোন এক সময় এটা হবে। এটি হলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে যাবে এবং তাঁদের কৃষি কাজ করতে কায়িকশ্রম ব্যবহার আরও সহজতর হবে।

সমবায় ভিত্তিতে উৎপাদনে কোন সুবিধা হবে কি না? এমন ক্ষেত্রে উন্নত দেশ কি করে? ধান উৎপাদনের ঝুকি কিভাবে সামলানো সম্ভব?

আমাদের দেশে বর্তমানে খামারীর সংখ্যা ২.৮৭ কোটি যার মধ্যে ১.৫২ কোটি খামারীর চাষযোগ্য জমি রয়েছে এবং যার গড় আয়তন মাত্র ১.৪৮ একর। স্বল্প পরিমান জমিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার ব্যয় সাশ্রয়ী নয় ফলে খামারের আয়তন বাড়ানো দরকার এবং উন্নত দেশে খামারের গড় আয়তন বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ অপেক্ষাকৃত কম হয়। সেজন্য আমাদের দেশের অকৃষি কাজের পরিধি বাড়ায় পূর্বের তুলনায় খামরীর সংখ্যা কিছুটা কমছে। তবে সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদ করা সম্ভব হলে উৎপাদন খরচ পর্যায়ক্রমে কমে আসবে। অতিবৃষ্টি, হঠাৎ বৃষ্টি, বন্যা, খড়া, ঘূর্নিঝড়, পোঁকা-মাকড়ের আক্রমন এবং বিভিন্ন রকমের রোগ বালাই এর কারনে ধান উৎপাদনে ঝুঁকি রয়েছে। এগুলো ধান উৎপাদনে যে কোন সময় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এটা মাথায় রেখে আর আপদকালীন সময়ের ধান মজুদ রেখে চাল রপ্তানীর চিন্তা করা যেতে পারে। চাল রপ্তানীতে আমাদের যাওয়া উচিৎ কারন চাল উৎপাদনে আমাদের তুলনামূলক সুবিধা বেশি রয়েছে।

জাতীয় বাজেটে কিছু করার আছে কিনা? কৃষি যন্ত্রপাতির দাম কমানোর ব্যবস্থায় কৃষক উপকৃত হবে কি না? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করে বাজেট করার পরামর্শ দিয়েছেন। এটা খুবই ভাল উদ্যোগ তবে অর্থনীতিতে উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে কৃষকদের সাথে পরামর্শ করারও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কৃষিজাত উৎপাদনের উপকরন খরচ কমিয়ে আনার আরও যৌক্তিক পদক্ষেপ বাজেটে থাকলে কৃষক উপকৃত হবে। সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সম্মানীত সদস্য (সিনিয়র সচিব) প্রফেসর ড. শামসুল আলমের মতে সরকার কৃষি খাতের জন্য যা সম্ভব সবই করছে। ভর্তুকি আছে সার, কীটনাশক, বিদ্যুত, সেচ এবং কৃষি যন্ত্রপাতিতে তো ৬০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়ে আসছে। এ ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। তবে বড় বড় কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকির সুবিধাভোগীর সংখ্যা সীমিত বিধায় সকল কৃষক উপকৃত হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে কৃষি যন্ত্রপাতির আমদানীতে শুল্ক আরও কমিয়ে সার্বজনীন করা হলে কৃষক তা ব্যবহার করতে উৎসাহিত হবে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে। বাজেটে শস্যখাতের পাশাপাশি মৎস্য ও প্রানী সম্পদ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন কারন মাছের দাম খুব বেশি না বাড়লেও দুধ, ডিম এবং মাংশের দাম অত্যধিক বেশি যা প্রান্তিক চাষী বা সাধারণ ভোক্তাদের নাগালের বাইরে। ধানের দাম কম থাকলে তা ধান চাষীদের নিকট আরও দুষ্পাপ্য হয়ে উঠে।

অন্যান্য জিনিসের দামের ন্যায় চাল একটু বেশি দামে কিনলে তাতে ক্ষতি খুব বেশি কি না? একটা বিষয় সব সময় লক্ষনীয় তা হলো আমরা চাল বাদে সকল জিনিস বেশি দামে কিনতে প্রস্তুত। চালের দাম একটু বাড়লেই প্রচার মাধ্যম সক্রিয় হয়ে উঠে, রাজনীতিতে অস্থিরতা বেড়ে যায়, সরকারের তদারকি বাড়ে অথচ বাজারের অন্যান্য কিছুর বিষয়ে এমন আচরণ কম দেখা য়ায়। চালের মূল্য বাড়লে কৃষক উপকৃত হবে সে বিষয়টা কিন্তু উপেক্ষিতই থেকে যায়। আমি জানি অনেকেই হয়তো বিষয়টি ভিন্নভাবে নিতে পারেন তবে এটা সত্য যে, আজ আমরা কৃষকের প্রতি খুব বেশি সহয়ানুভূতি দেখাচ্ছি কিন্তু দুইদিন পরেরই চালের দাম একটু বাড়লেই যেন তা ভুলে না যাই। চালের দাম বৃদ্ধিও জন্য সরকারকে খুব বেশি দোষারোপ করতে শুরু না করি। সরকারের সমস্যা হলো আমরা সবাই সবকিছু সরকারের কাছে চাই আবার তাও শুধু ভালটা। অনেকেই হয়তো অবগত আছেন, আমেরিকাতে সকল ক্ষেত্রে আর্মিদের অগ্রাধিকার দেয়া হয় কারন তারা দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ স্বীকার করে। আমাদেরও উচিত কৃষকদের বিষয়টি সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে দেখা। তাদের উৎপাদিত একটু বেশি দামে কিনতে দ্বিধা না করা। তাহলে সমস্যার সমাধান অনেক সহজ হবে।

কৃষিবিদ মন্ত্রী হলেই কি সব সমস্যার সমাধান দেয়া সম্ভব? যারা মনে করেন সরকার বা কৃষি মন্ত্রী মহোদয় চাইলেই সব করা সম্ভব। আমার মনে হয় তা আসলে না। আমাদের সবাইকেই যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই কেবল সমস্যার উল্লেখযোগ্য সমাধান সম্ভব। কৃষি বিষয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং রয়েছে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা। তাঁর আন্তরিকা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকার কারন নেই। দেশের সার্বিক চাহিদা স্থিতিশীল রেখে চাল রপ্তানির ভাবনার অবশ্যই যুক্তি আছে। অবশ্য যারা সমালোচনা করছেন তারা কোন ভাবেই চালের সরবরাহ বিষয়ে ঝুঁকিতে যেতে চাচ্ছেন না এটাও তাদের ভাল উদ্দেশ্যেরই বহিপ্রকাশ। চাল রপ্তানী যে সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং তা তিনি ভালভাবেই জানেন। বাজারসহ সকল ক্ষেত্রে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি বলেই সরকারের নিকট আমাদের প্রত্যাশাও বেশি। তাতে দোষের কিছু নেই এবং সেই বিশ্বাসকে অটুট রাখতে সরকারের দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি। এও সত্য যে, বিশ্বে চাল রপ্তানীর বাজার তৈরির জন্য ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মত আমাদেরও ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া দরকার।

ধান চালের বাজার স্থিতিশীল করতে দীর্ঘ মেয়াদে কি পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে? আমাদের ভাতাভ্যাসের কোন পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে পারি কি না? শ্রমিকের মূল্য বৃদ্ধি ধান চাষের জন্য খারাপ হলেও সমাজের দরিদ্র শ্রেনির মানুষের জন্য ভাল এবং এটাতে কোনভাবেই কোন কৃত্রিম সিন্ডিকেটের প্রভাব নেই এটা অবধারিত সত্য। শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির মূল কারন অকৃষি কাজের পরিধিবৃদ্ধি এবং অর্থনীতির অন্যান্য খাতে বেশি প্রবৃদ্ধি হওয়ায় সেখাতগুলোতে বেশি সংখ্যায় শ্রমিক নিয়োজিত করার সুযোগ। মোট কথা শ্রমের বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে। এটা আবার সবসময় সচল থাকবে তাও কিন্তু নয়। ফলে কৃষকের নিকট অর্থনীতির যোগান-চাহিদার ভারসাম্যের ভিত্তিতে শ্রমের দাম নিধারিত হলেও ধান বা চালের দামের ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে না কারন রাজনৈতিক একটি চাপ সেখানে প্রভাব বিস্তার করছে।

এছাড়া অতি মুনাফালোভী মধ্যস্বত্বভোগীদের একটি চক্র ধান-চালের বাজার নিয়ন্ত্রনে সর্বদা সক্রিয়। আগেই বলেছি বাংলাদেশে চালের দামের সাথে রাজনীতির একটা সংযোগ রয়েছে। যে কারনে ধান-চালের দাম বাড়ানোতে সরকারের একটি নেতিবাচক মনোভাব কাজ করে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সরকারের পক্ষ থেকে ধানের দাম বৃদ্ধি করারও একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা ধান উৎপাদনকারী কৃষকের জন্য মঙ্গলজনক। তবে এটি অধিক মাত্রায় বাড়ানো দেশের সাধারণ মানুষের জন্য খুব বেশি ভাল না কারন সাধারন মানুষ চালটা পরিমানে বেশি ক্রয় করে এবং বেশিরভাগ প্রান্তিক কৃষকও বছরের অন্যান্য সময় বাজার থেকে চাল ক্রয় করে জীবন ধারন করে থাকে। তবে শ্রমিকের অধিক দাম এবং ধানের নিম্ন বাজারমূল্য ধান উৎপাদনে ধীরে ধীরে অনিহা তৈরি করতে পারে যার ধনাত্মক প্রভাব পরতে পারে বিকল্প শস্য সবজি উৎপাদনে যার বাজারমূল্য অপেক্ষাকৃত বেশি। সবজির উৎপাদন বাড়লে কৃষকের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে পাশাপাশি ধীরে ধীরে জনসাধারণের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটাতে সহায়ক হবে। অর্থাৎ সাধারন মানুষ খাবারে ভাতের আধিক্য কমিয়ে বিকল্প হিসেবে সবজির পরিমান বেশি খাবে। বাংলাদেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৩৭৬ গ্রাম বা তার বেশি পরিমান চালের ভাত খায়। অন্যদিকে অন্যান্য তরিতরকারি ও সবজি খায় মাত্র ১১২ গ্রাম। খাবারে কার্বহাইড্রেড এর পরিমান বেশি হওয়ায় ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। তাই খাদ্যাভাসে ভাতের ব্যবহার কমানো খুবই জরুরি। সত্তরের দশকে দুর্ভিক্ষের সময় দেখা গেছে চালের মূল্য বেশি হওয়ায় মানুষ অল্প ভাতের সাথে বেশি পরিমানে সহজপ্রাপ্য সবজি মিশিয়ে খেয়েছে। সবজি উৎপাদন বাড়লে এবং কিছুটা সস্তা হলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি ক্রয় করবে। এতে বড় ধরনের একটি লাভ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পাওে, তাহল অদূর ভবিষ্যতে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটবে যা স্বাস্থ্য সচেতন সমাজ ব্যবস্থার জন্য খুবই ভাল খবর।

ধানের দাম অত্যধিক কম হলেও কি কৃষক ধান উৎপাদন করবেই? কোন বিকল্প উৎপাদনে কি কৃষক কখনও ধাবিত হবে না? কৃষক অভ্যাসবশত: ধান চাষ করবেই এটা যে নিশ্চিত সত্য নয় তা কিন্তু আমরা পাটচাষের ক্ষেত্রে প্রমান পেয়েছি। এক সময় কৃষক প্রচুর পরিমানে পাট চাষ করতো কারন পাটের বাজার মূল্য বেশি ছিল। উন্নত দেশে পাটের বিকল্প তৈরি হওয়ায় দাম পড়ে যায় ফলে কৃষক পাট উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ধানের দৈনন্দিন পারিবারিক চাহিদা রয়েছে বিধায় পাটের সাথে সম্পূর্ন মিলবে না তবে অতিরিক্ত উৎপাদনে দামের বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় আসতে বাধ্য। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চাষীরা কবওয়েব মডেলেকে বেশি অনুসরণ করে বলে প্রতীয়মান হয় অর্থাৎ দাম কমে গেলে কৃষক পরের বছর সে পণ্য কম পরিমানে আবাদ করে এবং কম উৎপাদন হলে বাজার মূল্য বেশি হলে সে পণ্য আবার পরের বছর বেশি পরিমানে আবাদ করে। এমন একটি চক্রে কৃষক আবর্তিত হতে থাকে। ধানের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটি হয় না তার কারন এটি আমাদের প্রধান খাবার। মানুষের দীর্ঘদিনের অভ্যাসগত পরিবর্তন ঘটানো মোটেও সহজকাজ নয়। তবে এটার পেছনে অর্থনৈতিক সংযোগ থাকলে দীর্ঘমেয়াদে পরিবর্তন আসবেই একথার উপর বিশ্বাস রাখা যায়। মানুষের শিক্ষাগত যোগ্যতা এক্ষেত্রে ধনাত্মক নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার হার ৭২.৮ শতাংশ এবং এ হার পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকবে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়লে খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন দ্রুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আমাদের দেশে ধান বাদে কৃষির অন্যান্য খাত থেকে উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্য বেশি এবং ওগুলোর সাথে তথাকথিত রাজনৈতিক যোগসূত্র কম থাকায় ভাল দামও পাওয়া যাচ্ছে ফলে কৃষকদেরকে পর্যায়ক্রমে সেদিকে উৎসাহিত হতে হবে। সবজি উৎপাদন বাড়লে এবং ধান উৎপাদন কমতে থাকলে চালের অধিক বাজার মূল্য ভাতের প্রতি আসক্তি কমাতে পারবে বলে মনে হয় কিন্তু এটা ভেবে বসে থাকলে চলবে না। রাতারাতি এটা হয়ে যাবে তাও মনে করার কারন নেই। সাধারণ মানুষ ও কৃষকদেরকে সেদিকে ধাবিত করতে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সরকারী নীতি-নির্ধারনী পর্যায়েও পরিবর্তন আনতে হবে। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে রাজনীতিবিদদের ভূমিকা অনেক। প্রচার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও সাধারণ মানুষের অভ্যাস ও ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসতে হবে। তার জন্য প্রয়োজনে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বপরি, বাজার নিয়ন্ত্রনে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, বিভাগ, আইন শৃংখলা বাহিনী তাদের নিয়মিত কাজের অংশ হিসাবে সারা বছর সক্রিয় থাকবে-এটা সকলেরই প্রত্যাশা।

লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোঃ সাইদুর রহমান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ফুলব্রাইট স্কলার, যুক্তরাষ্ট্র

  •  
  •  
  •  
  •