বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস আজ

হালিমা তুজ সাদিয়াঃ
তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার নিমিত্তে ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে প্রতি বছর ৩১ মে, বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এবং তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সাল থেকে ৩১ মে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস প্রতি বছর আলাদা আলাদা প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হয়ে আসছে।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে “Commit to quit” অর্থ্যাৎ ছেড়ে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
স্বাস্থ্যের উপর তামাক অনেক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। অকাল মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধির শীর্ষে তামাক। যত লোক তামাক ব্যবহার করে তার প্রায় অর্ধেক এর ক্ষতিকর প্রভাবে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় ৮০ লাখ লোক তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যায় (সর্বমোট মৃত্যুর প্রায় ১০%) যার প্রায় ৬ লাখ পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার। বিংশ শতাব্দীতে তামাক প্রায় দশ কোটি ব্যক্তির মৃত্যু ঘটিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (CDC) সেন্টারও এটাকে সারাবিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছে। দীর্ঘকাল ধূমপানের ফলে সার্বিক গড়ায়ু অধূমপায়ীদের তুলনায় ১০ বছর থেকে ১৭.৯ বছর পর্যন্ত হ্রাস পায়।
১. তামাক মূলত হৃৎপিণ্ড, লিভার ও ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। তামাকসৃষ্ট অন্যতম ক্ষতিকর দ্রব্য সিগারেট। গবেষণা বলছে, সিগারেটে প্রায় সাত হাজারেরও বেশি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ থাকে, যা বিভিন্ন রোগের সৃষ্টির কারণ। এর ৭০টি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ সরাসরি ক্যান্সার সৃষ্টিতে সক্ষম। যেমন নিকোটিন, কার্বন মনোঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, বেনজোপাইরিন, ফরমালডিহাইড, অ্যামোনিয়া, পোলোনিয়াম ২১০-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ধূমপানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), এমফাইসিমা ও ক্রনিক ব্রংকাইটিস সহ অনেক রোগ সৃষ্টি হয়।
সিগারেটে প্রায় পঞ্চাশ এরও বেশি রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে যারা মানব শরীরে ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে যেমন- ফুসফুস ক্যান্সার, কিডনির ক্যান্সার, ল্যারিংসের ক্যান্সার, মূত্রথলির ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার,অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার,ও পাকস্থলী ক্যান্সার,নারীর জরায়ু ক্যান্সার। এছাড়া এর সাথে আরো অনেক ক্যান্সারের সম্পর্ক রয়েছে যেমন- স্কোয়ামাস সেল সাইনোন্যাজাল ক্যান্সার, লিভার ক্যান্সার, কলোরেক্টাল ক্যান্সার, পিত্তাশয় ক্যান্সার, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির ক্যান্সার, ক্ষুদ্রান্ত্রের ক্যান্সার ও শিশুদের বিভিন্ন ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ ও প্রান্তীয় রক্তনালীর রোগ, হার্ট অ্যাটাক, ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ, এমফাইসিমা, অ্যাথেরোসক্লেরোসিস (করোনারি ও প্রান্তীয় ধমনির রোগ) প্রভৃতি রোগের সৃষ্টি করে।
২. ধূমপানকারীদের হাতের আঙুলে বিশেষ করে ২য় ও ৩য় আঙুলে তামাকের বা নিকোটিনের দাগ দেখা যায়।
৩. সিগারেটের ধোঁয়ায় যে কার্বন মনোক্সাইড থাকে তা রক্তের অক্সিজেন বহন ক্ষমতা কমিয়ে দেয় ফলে ধূমপানের এক মিনিটের মধ্যে হার্টের স্পন্দন বাড়তে শুরু করে এবং প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে হার্ট রেট প্রায় দশ শতাংশ বেড়ে যায়। হাত ও পায়ের ধমনি ও শিরায় প্রদাহ হয় এবং থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বেঁধে যায়। ফলে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়ে ঘা বা ক্ষত তৈরি হতে পারে।
৪. ধূমপায়ীরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয় বেশি এবং রোগের তীব্রতাও অনেক বেশি।
৫. তামাকসেবীদের হ্যালিটোসিস বা মুখে দুর্গন্ধ হয়। দাঁত ক্ষয়ে যাওয়ার হার দুই থেকে তিনগুণ বৃদ্ধি পায়। এছাড়া লিউকোপ্লাকিয়া নামক আরেক ধরনের জটিলতা হতে পারে যাতে মুখগহ্বরের মিউকাস ঝিল্লিতে সাদা প্লাক দেখা দেয়।
৬. অধূমপায়ীর তুলনায় ধূমপায়ীরা যৌন অক্ষমতায় ভোগার হার ৮৫ শতাংশ বেশি।
৭. বন্ধ্যাত্ব- ধূমপান ডিম্বাশয়ের জন্য ক্ষতিকর এবং বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ। সিগারেটের নিকোটিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান ইস্ট্রোজেন হরমোন তৈরিতে বিঘ্ন ঘটায়। এই হরমোনটি ডিম্বাশয়ে ফলিকল উৎপাদন ও ডিম্বপাত নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ধূমপান জরায়ু ও ভ্রূণের আরো অনেক ক্ষতি করে।
৮. অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীদের বিবাহ বিচ্ছেদের সম্ভাবনা প্রায় ৫৩% বেশি।
৯. ধূমপানের ফলে ক্ষুধা কমে যায়। তামাক লিপিডের ভাঙন ত্বরান্বিত করে এবং ওজন কমায়। সারাবিশ্বে আগুনজনিত মৃত্যুর ১০% ধূমপান থেকে হয়। ধূমপায়ীরা রেডন ও অ্যাসবেসটস এর সংস্পর্শে এলে ফুসফুসের ক্যান্সারের সম্ভাবনা অধূমপায়ীর তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়। ধূমপানের ফলে অস্থি ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
১০. ধূমপানের কারণে এর মধ্যস্থিত বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান যেমন কার্বন মনোক্সাইড, সাইয়ানাইড প্রভৃতির সংস্পর্শে দীর্ঘদিন থাকার ফলে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ফুসফুসের অ্যালভিওলাই এর স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে যায় যার ফলে এমফাইসিমা নামক রোগ হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যারা ধূমপান ও তামাক সেবন করেন তাদের কোভিড ১৯-এর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ধূমপান বা তামাক সেবন ফুসফুস ও দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গে ক্ষতি করে এবং কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ধূমপান এবং জর্দা, গুল ও সাদাপাতা ফুসফুস ও শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। যেহেতু তামাকপণ্য ফুসফুসের সংক্রমণ ও অসুস্থতা বাড়ায় এবং শরীররে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়, যা করোনা সংক্রমণরে জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কাজেই কোভিড-১৯ মোকাবেলার একমাত্র পথ হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নিজের শরীর সুস্থ রাখা, বিশেষ করে ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু সেবন করা থেকে বিরত থাকা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যারা ধূমপান ও তামাক সেবন করেন তাদের কভিড ১৯-এর আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। ধূমপান বা তামাক সেবন ফুসফুস ও দেহের অঙ্গপ্রতঙ্গে ক্ষতি করে এবং কভিড ১৯-এ আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তামাক ও তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো থেকে প্রতিবছর সরকারের যে রাজস্ব আদায় হচ্ছে, পরোক্ষভাবে তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত লোকদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ের জন্য। তামাক সেবনের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে জিডিপিতেও।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে মারা যায় ৯৫ হাজার মানুষ। পঙ্গুত্ব বরণ করে আরও কয়েক লাখ। এসব ক্ষেত্রে রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য খরচ তামাক খাত থেকে পাওয়া রাজস্বের অনেক বেশি। তামাক ব্যবহারের ফলে দেশের অর্থনীতিতে বছরে নিট ক্ষতির পরিমাণ দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১.৪ শতাংশ। বর্তমানে এই ক্ষতির পরিমাণ স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেড়েছে।
তামাক চাষের ফলে মাটির ক্ষয় হয়, উর্বরতা কমে যায়। মাটি শক্ত হয়ে যায়। অন্য ফসল ভাল হয়না।
তাই তামাকের করালগ্রাস থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য এর বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা জরুরি। আর ধূমপান প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরি ও কার্যকরী পদক্ষেপ হলো ব্যক্তির সদিচ্ছা ও একান্ত প্রচেষ্টা। একজন ব্যক্তি যদি সচেতনভাবে ধূমপানকে এড়িয়ে চলে, আসক্ত হতে না চায় কিংবা ধূমপান ছাড়তে চায় তাহলে সে খুব সহজেই তার মনোবল দিয়ে ধূমপানকে প্রতিরোধ করতে পারে। আর বিশ্বজুড়ে ধূমপান এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছে যে একে প্রতিরোধ করতে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগই যথেষ্ট নয়। বরং বড় পরিসরে, সরকারিভাবে এর বিরুদ্ধে শক্তিশালী উদ্যোগ নিতে হবে।
ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্তসহ সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও গণপরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে শতভাগ ধূমপানমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তামাকজাত পণ্য বিক্রয়স্থলে দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে হবে। তামাক কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি বা সিএসআর সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। খুচরা সিগারেট বা বিড়ি বিক্রি বন্ধ করতে হবে। সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টস (এইচটিপি)-এর মতো ক্রমশ বিস্তার লাভ করা পণ্যসমূহের আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধিসহ তামাকপণ্য মোড়কজাতকরণে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।
লেখকঃ হালিমা তুজ সাদিয়া, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।