বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং বাংলাদেশের সম্ভাব্য পরিনতি

হালিমা তুজ্জ সাদিয়াঃ

তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে সাধারণ উষ্ণয়ন নামে অভিহিত করা হয়। আর বিশ্ব উষ্ণায়ন বলতে- বায়ুমন্ডলীয় তাপমাত্রার ক্রমান্বয় বৃদ্ধিকে অর্থাৎ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াকে। বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming) বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত প্রধান সমস্যাসমূহের অন্যতম।

বিশ্ব উষ্ণায়নে গ্রিন হাউস গ্যাসের বৃদ্ধিই অন্যতম কারণ। গ্রিন হাউস গ্যাসের মধ্যে রয়েছে- কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন এবং ওজোন।

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব:

১. জলবায়ুর পরিবর্তন: বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীব্যাপী আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন শুরু হয়েছে। যার প্রভাব পৃথিবীর প্রতিটি দেশের উপর পড়ছে। ১৯৯৫ সালকে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম বছর হিসেবে গননা করা হয়। সাইবেরিয়ার বেশির ভাগ অংশের তাপমাত্রা পূর্ববর্তী শতক গুলির তুলনায় ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রান্তীয় অঞ্চল গুলি আরো উষ্ণ ও শুষ্ক হচ্ছে। IPCC এর রিপোর্ট অনুসারে বলা হয়েছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ সেমি। তারা আরো অনুমান করেছেন যে আগামী ১০০ বছরে অর্থাৎ ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো ১.৪ ডিগ্রি থেকে ৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়তে পারে ২০ থেকে ৮৮ সেমি পর্যন্ত, ফলশ্রুতিতে মানবজীবন পড়বে এক ভয়ংকর পরিস্থিতিতে।

২.হিমবাহের গলন: মেরু অঞ্চলে যে হিমবাহের চুড়া গুলি হাজার হাজার বছর ধরে অক্ষত অবস্থায় ছিল আজ সেই বরফ গুলি বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে অতি দ্রুত গলিত হয়ে যাচ্ছে। এত দ্রুত হারে গলে যাচ্ছে যে আর ৮০ বছরের মধ্যেই তার এক-তৃতীয়াংশ বরফ পুরোপুরি গলে যাবে। আর বিশ্ব উষ্ণায়নের তাপমাত্রার বাড়া-বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখা যায়, তা হলেও অর্ধেক বরফই গলে যাবে হিন্দুকুশ পর্বতমালার। উষ্ণায়নের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই গলে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ। আর ৪০ বছরেই ভেসে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকংয়ের অববাহিকা তার ফলে, ওই অঞ্চলে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকং-সহ প্রধান যে ১০টি নদী রয়েছে, পুরোপুরি ভেসে যাবে তাদের অববাহিকাগুলি। তার ফলে, বিপন্ন হয়ে পড়বেন ভারত, পাকিস্তান, চিন, আফগানিস্তান, নেপাল, ভূটান-সহ. ৮টি দেশের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ। তার পর সেই হিমবাহগুলির বরফ শেষ হয়ে গিয়ে সেগুলি রুখুসুখু পাথর হয়ে যাবে। ফলে, সেই সব উৎস থেকে বেরিয়ে আসা নদীগুলি পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে।

৩.সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি: বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য মেরু অঞ্চলে সঞ্চিত থাকা বরফ চূড়া গুলি অতি দ্রুত গলে যাচ্ছে, যার ফলে সমুদ্র জলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষেত্রে দক্ষিণ- পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলির উপকূলবর্তী অঞ্চল গুলিতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ বসবাস করে, সেই মানুষ গুলিও একটি বিরাট সমস্যার সম্মুখিন পর্যন্ত হতে পারে।

৪. বন্যার প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি: বিশ্ব উষ্ণায়ন জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটিয়ে জলবায়ু সম্পর্কীত দূর্যোগ, যেমন – ঝড়, বন্যা প্রভৃতির পরিমান বৃদ্ধি পাবে।

৬. মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব: বিশ্ব উষ্ণায়ন মানুষের স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। প্রাথমিক ভাবে বলা যায় বিশ্ব তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশ গুলিতে তাপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ক্রান্তীয় অঞ্চলও উষ্ণ থেকে আরো উষ্ণতর হচ্ছে। গ্রীষ্মকালে এই তাপ প্রভাবের কারণে আজ সারা বিশ্ব ব্যাপী অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। উষ্ণায়নের কারণে জীবাণু ঘটিত রোগের পরিমাণও বাড়ছে। পতঙ্গ বাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া এই বিশ্ব উষ্ণায়নের সাথেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্ত।

৭. জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব: IPCC এর রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান সময়ে যে সব জীব বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার মূলেও রয়েছে এই বিশ্ব উষ্ণায়ন জনিত জলবায়ুর পরিবর্তন।

৮. কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব: বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তন কৃষিজ উৎপাদন কে প্রভাবিত করছে, বিশেষ করে ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্গত আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার দেশ সমূহের উপর,যেখানে পূর্বে থেকে ফসলের উৎপাদন হয় খুব কম। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ফসল বলয় গুলি ক্রমশ উচ্চ অক্ষাংশীয় অঞ্চলের দিকে সরে যাচ্ছে এক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

৯. তাপ প্রবাহ: আবহাওয়া জনিত দূর্যোগ গুলির মধ্যে অন্যতম হল তাপ প্রবাহ, যা পূর্বে উষ্ণ ক্রান্তীয় অঞ্চলের দেশ গুলিতে গ্রীষ্মকালে মাঝে মধ্যে দেখা যেত কিন্তু আজকের সময়ে সেই তাপ প্রবাহের সংখ্যা ও স্থায়ীত্ব অনেক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই তাপ প্রবাহ আজ কেবল মাত্র ক্রান্তীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয় নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের দেশ গুলিতেও গ্রীষ্মকালে এই তাপ প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। তাপ প্রবাহের তীব্রতা বৃদ্ধির এক মাত্র কারণ হল বিশ্ব উষ্ণায়ন। যার ফলে প্রতি বছর অনেক মানুষ প্রান হারাচ্ছে।

১০. খরার প্রবনতা বৃদ্ধি: কোন অঞ্চলে কোন নির্দিষ্ট সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টিপাতের পরিমান কম হলে খরা হয়েছে বলে ধরা হয়। সাধারণত বৃষ্টিপাতের জন্য খরার সৃষ্টি হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাতের অভাবে জলের বিভিন্ন উৎস গুলি শুকিয়ে যায়, সেই উৎস গুলি থেকে মানুষের প্রয়োজনীয় জলের ঘাটতি দেখা যায়, পুকুর, নদী এমনকি ভৌম জলের অভাব দেখা যায়।

তাপমাত্রার এরুপ বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হবে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা:

বিগত ১০০ বৎসরে তাপমাত্রা ০.৫°সে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু পরবর্তী ৫০ বৎসরে, অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ১.৫°-২.০° সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হয়, আর এভাবে বৃদ্ধি পেলে পানিচক্রের তীব্রতার বৃদ্ধি ঘটে এবং বাষ্পীভবনের হার ১২% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী অধঃক্ষেপণ (বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, শিশিরপাত ইত্যাদি)-এর মাত্রা বৃদ্ধি পাবে। আইপিসিসি উদ্ভাবিত জলবায়ু মডেল নির্দেশ করছে যে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগেরও অধিক বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশ প্রায়শই ধ্বংসাত্মক বন্যা কবলিত হয়। গত দুই দশকের মধ্যে ব্যাপক বন্যার ঘটনা ঘটে ১৯৮৭, ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালে। এসব বন্যায় দেশের অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে এবং শস্যক্ষেত্রের ফসল বিনষ্ট হয়।পরবর্তীতে এই অবস্থা ভয়ংকরভাবে দাঁড়াতে পারে।

বিজ্ঞানীরা আরও আশঙ্কা করছেন যে, অত্যাধিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে যা ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে। একটি উষ্ণতর জলবায়ু বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের প্রকোপ আরও বৃদ্ধি করবে এবং তাতে দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তনের ফলে জোয়ারভাটা, বায়ুমন্ডলীয় চাপ, বাতাসের বেগের সৃষ্টি হয় যার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের অবিরাম পরিবর্তন ঘটে, তবে দীর্ঘমেয়াদে সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন একমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে থাকে। বিশ্ব উষ্ণায়ন ফলে তাপমাত্রার বৃদ্ধি পেয়ে মেরু ও পর্বতের বরফশীর্ষ এবং বরফের চাঁই গলে যাবে, বাংলাদেশের একটি বিশাল এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জলমগ্ন হবে। দেশটির কত অংশ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যেতে পারে তা নির্ভর করবে এর সঙ্গে সম্পর্কিত সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনের ওপর। একটি টাস্কফোর্স প্রতিবেদন এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে প্রায় ২২,৮৮৯ বর্গ কিমি ভূমি সমুদ্রে হারিয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের মোট এলাকার প্রায় ১৫.৮%।

একটি নিম্নাঞ্চলীয় এবং উচ্চ জনসংখ্যা ঘনত্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জোয়ারভাটার তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকাসমূহে ভূমিক্ষয় এবং প্লাবনের মতো ঘটনা ঘটবে। সমুদ্রের লবনাক্ত পানি ভিতরে চলে আসবে যার ফলে কৃষিজমি এবং মিঠাপানির প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে যাবে। উপকূলীয় সীমানার আকৃতির পরিবর্তন ঘটবে। এতে বাংলাদেশের ভূভাগ সংকুচিত হয়ে যাবে।অতি তাপদাহের ফলে কিছু কিছু জায়গা মরুভূমির মতো অবস্থার অবস্থার সৃষ্টি হবে।

বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির কারণ:

১৭৫০ সালের দিকে শিল্প বিপ্লবের পর ২০১৭ সাল পর্যন্ত মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে বায়ুমন্ডলে ৪০% কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস বৃদ্ধি হয়েছে। কার্বন ডাই অক্সাইডেরর এই বৃদ্ধির বেশীর ভাগই ঘটেছে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি, কয়লা, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ানোর ফলে। এছাড়াও বন ঊজার, ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় ও কৃষি ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের অবাদ ব্যবহার, জলাভূমি ডোবা-নালা, ময়লার ভাগাড় জৈব আবর্জনার স্তুপ, গৃহপালিত পশু, মল-মুত্র ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির কারণেও বায়ুমন্ডলে গ্রীণ হাউজ গ্যাসের বৃদ্ধি ঘটছে।

বর্তমানে গাছ-পালা কর্তন, নদী-খাল ভরাটের মতো কাজও অবাধে চলছে প্রবৃদ্ধি অর্জনের তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে। গভেষকদের ধারণা এই প্রতিযোগিতামূলক উন্নতি, অগ্রগতি, প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই লড়াই থামানো সম্ভব না হলে এবং পরিবেশ-বান্ধব নীতি ও কর্মসূচি গৃহীত না হলে অচিরেই আমাদের এই পৃথিবী অসহনীয় অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে। তাই পরিবেশমুখী মনোভাব সবার মাঝে পোষণ করা অত্যন্ত জরুরী, পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন, বিকল্প জ্বালানী ব্যবহার, জীবাশ্ম জ্বালানীর যথাযথ ব্যবহার, কলকারখানা, যানবাহন, কৃষি জমির সুষ্ঠু ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি অন্যথায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত চরম পরিস্থিতির ফলে অস্থির ও উষ্ণতার এই পৃথিবীতে মানুষ, উদ্ভিদ ও জীবের বসবাস করাটাই কঠিন ও কষ্টকর হয়ে যাবে। কারণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করলে এই জলবায়ুতে অভিযোজন সম্ভব হবে না। মানুষ ও বিভিন্ন প্রাণসমূহ চরম প্রাকৃতিক বৈরিতার মুখে ধাবিত হবে এবং ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকবে।

  •  
  •  
  •  
  •