বাংলাদেশের জি আই পণ্য খিরসাপাত আমকে ভারতীয় জি আই পণ্য হিমসাগর হিসেবে বিক্রি বন্ধ করুন

জয়তু কুমার মন্ডলঃ

আম কে বলা হয় ফলের রাজা। বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষও আম গাছ। লোক মুখে প্রচলিত আছে আম পৃথিবীর সবচাইতে সুস্বাদু ফল।

তামিল ভাষায় ম্যাংকে, চীনা ভাষায় ম্যাংকাও সেখান থেকেই বাংলা ভাষায় এর নাম করন আম।ধারনা করা হয় আমের জন্ম প্রায় সাড়ে ৬০০ বছর পূর্বে। জন্মস্থান নিয়েও রয়েছে নানা তর্ক বিতর্ক। আমের জাত নিয়েও রয়েছে বিরাট এক বৈচিত্র্যতা,ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষজ্ঞ গণ প্রায় ১ হাজার ৬৫০ টি জাতের তালিকা করেছিলেন। এই এত আমের জাতের মাঝে আমাদের দেশের একটি অন্যতম এবং সুস্বাদু জাতের আম খিরসাপাত।

খিরসাপাত আম আশু জাতের। জুন মাসের শুরুতেই এটি বাজারে আসতে শুরু করে এবং জুলাই এর মাঝামাঝি পর্যন্ত পাওয়া যায়। জুন মাসের ৭-৩০ তারিখ পর্যন্ত খিরসাপাত আমের মোক্ষম সময়। খিরসাপাত আম মাঝারি সাইজের, আকারে কিছুটা গোলাকৃতির,বোঁটা বেশ মোটা ও শক্ত-পোক্ত,পাকলে বোঁটার চারিপাশে হলুদাভ আভার রং ধারন করে। একেকটি আমের গড় ওজন প্রায় ২৬৩ গ্রামে হয়ে থাকে।

খিরসাপাত আমের উৎপত্তিস্থল নিয়ে মতভেদ থাকলেও এটি রাজশাহী,চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের একটি খুবই জনপ্রিয় জাত এবং প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়।বলাবাহুল্য খিরসাপাত আম বাণিজ্যিক ভাবে বেশ সফল।দেশব্যাপী এই আমের স্বাদ,মান ও গুনের ব্যাপক সুনাম ও চাহিদা রয়েছে। খিরসাপাত আম বাংলাদেশের জি আই (G.I)পণ্য।

এখন কথা হচ্ছে জি আই (G.I)পণ্য আসলে কী?

জি আই ( G.I) হলো জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন Geographical indication বা ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য। জি আই একটা নির্দিষ্ট সাইন যা একটা নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য ব্যবহার করা হয় এবং যা কোন নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকার পরিচয় বহন করে। WIPO( world intellectual property organisation) হচ্ছে জি আই পণ্যের স্বীকৃতি দানকারী প্রতিষ্ঠান। কোন দেশের জি আই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য সে দেশের ডিপিডিটি আবেদন করে থাকে। কোন একটি দেশের মাটি,পানি,আবহাওয়া এবং জনগোষ্ঠী যদি কোন একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করে থাকে তাহলে সেটিকে ঐ দেশের ভৌগলিক কিংবা জি আই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এতগুলো কথার একটি অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য রয়েছে,বিগত কয়েক বছর ধরে পরিলক্ষিত হচ্ছে দেশের বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট,বিশেষত ফেসবুক ভিত্তিক বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপ কোন এক অজানা কারনে খিরসাপত আমকে জেনে বুঝে কিংবা অজ্ঞতার কারনে হিমসাগর আম বলে অনায়েসে বিক্রি করছে।এ ক্ষেত্রে বাজারের চাহিদা একটি নজর দেবার মতন ব্যাপার আছে। দুঃখজনক ভাবে সত্য এই হিমসাগর আম খিরসাপাতের সদৃশ হলেও এটি আমাদের দেশের তেমন একটি জনপ্রিয় জাত না এবং হিমসাগর আম ভারতের জি আই পণ্য। আমরা অজান্তেই নিজেদের পন্য রেখে বাইরের একটি পন্যর ব্র‍্যান্ডিং করছি এবং এর বিশাল একটি সমস্যা রয়েছে দেশ তথা আন্তর্জাতিক বাজারে। জি আই পণ্যের সুবিধা ই হলো সংশ্লিষ্ট জি আই পণ্যের মালিক হবে সেই দেশ এবং ভৌগলিক পরিচিতি ও পাবে সেই দেশেই দেশ এবং সে দেশ ঐ পণ্যের সম্পূর্ণ ব্যবসায়ীক মুনাফার মালিক হবেন।আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সেই পণ্যের সত্ত্ব অন্য কোন দেশ দাবি করতে পারবেনা।

২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ আম উৎপাদনে ৭ম। যদিও ১৯৮০ সালে সেটি ছিল ৪র্থ। সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি করে ভারত,এরপরে রয়েছে চীন,ব্রাজিল,মায়ানমার এমন কী পাকিস্তানও। আমরাও ইউরোপে আম রপ্তানি করেছি কিন্তু কতটুকু? অতীতেও যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে আমাদের অনেক ইউনিক প্রোডাক্ট যার বিশ্বব্যাপী চাহিদা ছিল,তার বাজার আমরা ধরতে পারিনি। এর অন্যতম বড় কারন সেসব পণ্যের ব্র‍্যান্ডিং আমরা ঠিকঠাক করতে পারিনি এবং জি আই পণ্য হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারিনি। যেখানে খিরসাপাত আমের জি আই সনদ রয়েছে,এটি আমাদের ইউনিক প্রোডাক্ট অথচ আমরা নিজের অজান্তেই এটিকে হিমসাগর আম বলে বাজারে বিক্রি করছি এবং খিরসাপাত আমের বাজার নষ্ট করছি।

আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার ধরতে গেলে ব্র‍্যান্ডিং করতে হবে নিজেদেরই। ২০১৯ সালের ২৭ ই জানুয়ারি খিরসাপাত আম কে বাংলাদেশের ৩য় জিআই পণ্য (খাদ্যদ্রব্য) হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আসুন আমরা নিজেরাই আগে নিজদের পণ্য কে মূল্যায়ন করি, খিরসাপাত আমকে হিমসাগর বলে বিক্রি বন্ধ করি। ঠিকঠাক ব্র‍্যান্ডিং করতে পারলে আন্তর্জাতিক খিরসাপাত আমের একটি অপার সম্ভাবনা রয়েছে, এখনি নিজেদের জায়গায় থেকে সোচ্চার হলে হয়ত সামনে দশকে আম রপ্তানিতে শীর্ষ স্থানে নাম লেখাবে বাংলাদেশ।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3

Tags: , ,