কৃষিতে বিশেষ প্রণোদনা : যথাযথ বাস্তবায়নেই কেবলমাত্র সুফল বয়ে আনতে পারে

ড. মোঃ ওয়াকিলুর রহমান

কৃষি অর্থনীতি যেন সচল থাকে সেজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার একগুচ্ছ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। বিষয়টি অতি প্রত্যাশিত এবং প্রশংসনীয়। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকাএবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছেন বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিতহয়েছে।এই সময় উপযোগী ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। এর আগে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল ঘোষণার পর থেকে কৃষি সংশ্লিষ্ট সকলের দাবি ছিল কৃষির জন্য একটি বিশেষ প্রণোদনা, যা করোনার অভিঘাত মোকাবেলায় সহায়ক হবে।ঘোষিত প্রণোদনার ৫ হাজার কোটি টাকা পোলট্রি, কৃষি খামার, ফলমূল,মৎস্য ও মসলাজাতীয় খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের মাঝে ৫শতাংশ (১ শতাংশ কমিয়ে এখন ৪ শতাংশ করা হয়েছে) সুদে ঋণ প্রদান করা হবে বলে জানা গেছে। বর্তমান প্রেক্ষিতে এই ঘোষিত অর্থ ঋণ হিসাবে না দিয়ে অনুদান হিসাবে প্রদান করলে কৃষক বা খামারিরা বেশ উপকৃত হতেন । এমনকি এর একটি নির্দিষ্ট অংশ অনুদান হিসাবে প্রদান করলেও কৃষি পণ্য উৎপাদনকারীরা করোনা ধকল সফলভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হতেন।বাস্তবতার নিরিখে ৪ শতাংশ হারে ঋণ গ্রহণ করে কৃষকদের পক্ষে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া বেশ কষ্টকর হবে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে মসলায় ৪ শতাংশ হারে ঋণ সুবিধা বিদ্যমান। সুতরাং ঋণের ঘোষিত হার ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২-৩ শতাংশ করা যেতে পারে। অন্যদিকে ঘোষিত প্রণোদনা কৃষির উপ-খাতগুলোর মধ্যে কিভাবে বণ্টিত হবে এবং সার ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য প্রদত্ত তহবিল কি সম্পূর্ণ নতুন না পূর্বের সাথে সমন্বয় করা হবে তা এখনও বিস্তারিত জানা যায়নি, হয়তবা এটি নিয়ে কাজ চলছে।

কৃষিতে বনায়ন বাদে প্রধানত তিনটি উপ-খাত (কৃষি, প্রাণি ও মৎস্য সম্পদ)খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১৯মতে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৪৬ শতাংশ, মৎস্য খাতের অবদান ৩.৬১ শতাংশ এবং প্রাণিসম্পদের অবদান ১.৫৩ শতাংশ। শতকরা অংকে অবদান খুব বেশি না হলেও কৃষি সংশ্লিষ্ট উপ-খাতসমুহে উপর বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীনির্ভরশীল। কৃষি শুমারি ২০১৯ সালের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে মোট কৃষি খানার (পরিবার) সংখ্যা প্রায় ১.৬৬ মিলিয়ন (৪৬.৬১ %), যার মধ্যে ভূমিহীন প্রায় ৪ লক্ষ (১১.৩৩%) ও বর্গাদার প্রায় ৬.৭৬ লক্ষ (১৯.০৩%)। মৎস্যজীবী খানার সংখ্যা প্রায় ৯.৯৫ লক্ষ যা মোট খানার ২.৮৯ শতাংশ।পশুপালনের সাথে জড়িত প্রকৃত খানার সংখ্যা জানা না গেলেও মুরগি (১৮৯.২৬ মিলিয়ন), হাঁস (৬৭.৫৩ মিলিয়ন), গরু (২৮.৪৮ মিলিয়ন), ছাগল (১৯.২৩ মিলিয়ন), ভেড়া (০.৮৯ মিলিয়ন), ও মহিষের (০.৩৮ মিলিয়ন) সংখ্যা দেখলে বুঝা যায় যে এ উপ-খাতে বিপুল পরিমান জনগোষ্ঠী জড়িত। সংশ্লিষ্ট সকলেরসামগ্রিক প্রচেষ্টায় কৃষি ও কৃষি সংশ্লিষ্ট উপ-খাতসমুহ আজ একটি শক্ত ভিতের উপর দাড়িয়েছে। কিন্তু করোনার ছোবল এই শক্ত ভিতকে যে কোন সময় দুর্বল করে দিতে পারে যদি না যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ না নেওয়া হয়। তাই প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনার উপর বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনীতা বোধ করছি।

সারের ভর্তুকি বাবদ যে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা প্রশংসনীয়, তবে এটি আগের ভর্তুকির সাথে সমন্বয় করা হবে কিনা তা জানা যায়নি। সম্প্রতি ডিএপি সারের জন্য যে ভর্তুকি প্রদান করা হয়েছিল তার সুফল কৃষকেরা পেয়েছেন বলে মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় উঠে এসেছে। ভর্তুকির কারণে কৃষকেরা অধিক পরিমাণে ইউরিয়া সার ব্যবহার করেন বলে যে ধারণা করা হয়েছিল তা অনেকাংশে কমে এসেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। কৃষক পরিমিত সার ব্যবহার সম্পর্কে দিন দিন অবগত হচ্ছেন এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া সার ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন যে বৃদ্ধি হয় না সেটি তারা উপলব্ধি করছেন। প্রকৃত পক্ষে, সারের ভর্তুকি কৃষকদের সরাসরি উপকারে আসে। কাজেই মৃত্তিকাবিদের পরামর্শক্রমে কোন সার মাটির জন্য অতীব জরুরি অথচ কৃষকেরা পরিমাণে সেটি কম ব্যবহার করছেন,সে সকল সারে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট (দস্তা, বোরন, ম্যাংগানিজ, আয়রনইত্যাদি) ও জৈব (কেঁচো সার)সার ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভর্তুকি দেয়া যেতে পারে।

একইভাবে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য যে ১০০ কোটি বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেটিও চলতি ভর্তুকির সাথে সমন্বয় করা হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। করোনা প্রেক্ষাপটে কৃষি শ্রমিকের সংকট (বিশেষ করে ফসল লাগানো ও কাটার মৌসুমে) মোকাবেলায় কৃষি যান্ত্রিকীকরণের কোন বিকল্প নেই। কিন্তুকৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা যাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক পায় সেজন্য কৃষককে সংগঠিত করে কৃষক গ্রুপের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক এবং বিপণন প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।

বীজের জন্য যে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। গবেষণায় দেখা গেছে ভালো মানের বীজ ১৫-২০ ভাগ উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম। এখন প্রশ্ন হলো এ বরাদ্দ কি ভালো বীজ উৎপাদনের জন্য না কি বীজ বণ্টনের জন্য? তবে দুটিই প্রয়োজন। উন্নত মানের বীজ উৎপাদনের জন্য গবেষণা প্রয়োজন, এক্ষেত্রে কৃষি গবেষণা ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে কিছু বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। একইভাবে বিএডিসি কে বীজের পরিমাণ বৃদ্ধির (মাল্টিপ্লিকেশনের) জন্য ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে গুণগত বীজসমূহ প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের দোড়গোড়ায় পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে।

কৃষির আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপাদান হলো সেচ। শস্য ভেদে উৎপাদন খরচের প্রায় ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত সেচের জন্য ব্যয় হয়। কিন্তু সেচের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দ রাখা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়নি এবং মিডিয়াতেও উঠে আসেনি। সেচের জন্য সাধারণত বিদ্যুৎ ও ডিজেল তেল ব্যবহৃত হয়ে থাকে । বিদ্যুৎচালিত সেচ বাবদ২০ ভাগ ছাড় দেয়া হয়েছে যা সেচ পাম্প মালিকগণ পেয়ে থাকেন। কিন্তু এটিও সত্য যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের পক্ষে বিদ্যুৎচালিত পাম্প ক্রয় করা সম্ভব নয়। আমার জানা মতেকৃষকের জন্য ডিজেলে বিশেষ কোন ভর্তুকি নেই। তাই একজন বাস মালিক যে দরে ডিজেল ক্রয় করেন ঠিক একই মূল্যে কৃষকও সেচ এবং জমি চাষের জন্য ডিজেল ক্রয় করে থাকেন। সুতরাং ডিজেলে পরিচালিত সেচ পাম্প মালিকদের জন্য বরাদ্দকৃত অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় অনুদান দেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে।

আসন্ন ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে স্বল্পমেয়াদে গ্রামে গড়ে উঠেছে অনেক ছোট ছোট খামার যেখানে অনেক প্রান্তিক সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে অসহায়, বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্ত মহিলাকাজ করে থাকেন। অধিকাংশ নারী একটিবা দুটি করে গরু ও ছাগল পালন করে থাকেন যাদের জন্য একটি লাভজনক বিনিয়োগ হিসাবে ইতিমধ্যে গোটা দেশে বিস্তার লাভ করেছে। করোনার করাল গ্রাসে যাতে তাঁদের এই স্বল্প পুঁজির বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য বিশেষ নজর দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে অতিরিক্ত যে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার একটি অংশ পশুখাদ্য সহায়তা হিসাবে এসকল প্রান্তিক বিনিয়োগকারীকে দেয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যককৃষি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে বরাদ্দকৃত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সময়মত পৌঁছানো নিঃসন্দেহে কষ্টসাধ্য কাজ আবারএকেবারে অসাধ্য নয়। এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হলো সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন এবং তার যথাযথ বাস্তবায়ন। বরাদ্দকৃত গুচ্ছ প্রণোদনা বেশ বড় মনে হলেও তা এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য অপ্রতুল। তাই অর্থনীতির ভাষায় “সীমিত সম্পদের সুষম বণ্টন” নীতি অনুসরণ করা যেতে পারে। প্রথমত যা করতে হবে তা হলো ঋণ প্রাপ্তির জন্য একটি সুনির্দিষ্ট মানদন্ড (Criteria) নির্ধারণ করতে হবেযা প্রকৃতপক্ষে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক চিহ্নিত বা বাছাই করতে সহায়তা করবে। প্রণোদনার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করে প্রকৃত উপকারভোগী চিহ্নিতকরণের উপরকিন্তু আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।তাই এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন।

করোনার এই মহামারীতে সব কৃষক যে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তা কিন্তু সর্বাঙ্গে সত্য নয়। যেমন পোলট্রি, দুগ্ধ খামারি এবং সবজি চাষী যে পরিমাণক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা হবেন ঠিক একই পরিমাণে মৎস্য ও ধান চাষী ক্ষতিগ্রস্ত নাও হতে পারেন। ইতিমধ্যে পোলট্রি, দুগ্ধ খামারি এবং সবজি চাষীর দুর্দশার কথা পত্রিকার মাধ্যমে আমরা অবগত হয়েছি। তাঁরা তাদের উৎপাদিত পণ্য যেমন শাক-সবজি, দুধ, ডিম ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে উৎপাদনের জন্য পুঁজি ও আগ্রহ দুই’ই হারিয়ে ফেলছেন।

একইভাবে গত কয়েক বছর ধরে কৃষকেরা ধান চাষ করে লাভের মুখ দেখতে পারেননি। এবার বোরো মৌসুমে ভাল দাম না পেলে তারাও নিরুৎসাহিত হবেন। এমনকি ফলচাষীরাও করোনার অভিঘাত থেকে মুক্ত নয়। বিশেষ করে আম, পেয়ারা, কলা ও লিচু উৎপাদনকারীরা শীঘ্রই বিপণন সমস্যার সম্মুখীন হবেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

মাছ বাঙ্গালির আমিষের একটি প্রধান উৎস। বর্তমানে দৈনিক জন প্রতি মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬২.৫৮ গ্রাম যা এফএও কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে একটু বেশি (৬০ গ্রাম/দিন)। পাংগাস, তেলাপিয়াসহ অনেক মাছের দাম নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে বলে ধরে নেয়া হয়। কিন্তু মাছের খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মাছ চাষীরা এই স্বল্প দামে মাছ বিক্রি করে বিনিয়োগ হারাতে বসেছেন এবং দিন দিন মাছ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এছাড়া দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১.৩৯ শতাংশ মাছ ও মাছ জাতীয় পণ্য বিক্রি করে অর্জিত হয়। কিন্তু এ রপ্তানি আয়ে ব্যপ্তয় ঘটবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কাঁকড়া ও চিংড়ি রপ্তানির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়া শুরু হয়েছে।

বিপুল সংখ্যক বর্গাচাষী ও কৃষি শ্রমিকগণ ঘোষিত প্রণোদনা থেকে কিভাবে সুবিধা পাবেন তা স্পষ্ট হলে তারা আশ্বস্ত হতে পারতেন। কৃষি শ্রমিকগণ হয়ত পূর্বে ঘোষিত ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা প্রণোদনা থেকে কিছু সুবিধা পেতে পারেন। কিন্তু যারা অন্যের জমি চাষ করেন (নগদ অর্থ বা শস্য বিনিময়ের মাধ্যমে) তারা কিভাবে ঋণ সুবিধা পেতে পারেন তা বোধগম্য নয়। কৃষি ঋণের জন্য জমি বা পুকুরের মালিকানা থাকা একটি অন্যতম শর্ত। কিন্তু বর্গাচাষীরা এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হবেন। তাই জমির মালিকানা না থাকায় তাঁরা যেন ঋণ ( স্বল্প সুদে) সুবিধা থেকে বঞ্চিত না হয় সেটি লক্ষ রাখতে হবে।

বরাদ্দকৃত তহবিলের সুষম ও সুষ্ঠ বিতরণের জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

এক. উপজেলা কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কর্তৃক প্রকৃত এবং অধিক ক্ষতিগ্রস্তপ্রান্তিক, বর্গাচাষী, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। তালিকা তৈরিতে কর্মকর্তাবৃন্দ তাদের অধিনস্থ কর্মকর্তা বা সহকারীর সহায়তা নিবেন। যেমন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা ফসল চাষীর তালিকা তৈরিতে সহায়তা করবেন। সম্প্রতি দুগ্ধ খামারির যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে তা কাজে লাগানো যেতে পারে।প্রস্তুতকৃত তালিকা যাচাই বাছাই করে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখায়প্রেরণ করবেন। ব্যাংক দৈবচয়ন প্রক্রিয়ায় কিছু সংখ্যক কৃষকের তথ্য যাচাই বাছাই করেদ্রুততম সময়ে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

দুই. বাংলাদেশের গ্রামে প্রায় ১৪শতাংশ নারী প্রধান পরিবার বিদ্যমান, যাদের অনেকে কৃষি ও পশুপালনের সাথে সরাসরি জড়িত। কিন্তু তাদেরকে অনেক সময় কৃষক/খামারি হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় না ফলশ্রুতিতে, ঘোষিত প্রণোদনা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হতে পারেন।তাই নারী কৃষক/খামারিদের জন্য সীমিত সংখ্যক হলেও কোটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ডিজিটাল সুবিধা ব্যবহার করে সকল নির্বাচিত কৃষক ও খামারির তালিকা কৃষি বাতায়নে আপলোড করতে হবে যা পক্ষপাত দূর করতে সহায়তা করবে।

তিন. ঋণেরপরিমান চাহিদাভিত্তিক নির্ধারণ করতে হবে এবং শর্তসমূহ যথাসম্ভব শিথিল করতে হবে। ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বা কিস্তি এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে কৃষক তাঁর উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে পরিশোধ করতে পারেন।

চার. ঋণ প্রাপ্তিতে দুর্ভোগ বা হয়রানি বিষয়ে কৃষকের সন্দেহ দূর করার লক্ষ্যে প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ব্যাংক কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির মোবাইল নম্বর পোস্টারের মাধ্যমে জানাতে হবে। উক্ত পোস্টারে ঋণ প্রাপ্তিতে কৃষকের করণীয় লিপিবদ্ধ থাকবে। প্রয়োজনে অভিযোগ প্রদানের জন্য বিশেষ মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের ব্যবস্থা রাথতে হবে।

পাঁচ. বর্গাচাষীদের জন্য জমি জামানতের যে প্রচলিত বিধান আছে তা শিথিল করতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রকৃত ভূমির মালিক বা উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তার সুপারিশ গ্রহণ করা যেতে পারে।জমি জামানতের ভিত্তিতে ঋণ গ্রহণ বিষয়ে কৃষকের যে ভীতি বা অনীহা বিদ্যমান তা দূরীকরণের জন্য প্রচারণা চালাতে হবে।

ছয়. কৃষি একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ কিন্তু বর্তমানে বীমা সুবিধা না থাকায় অনেক সময় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যর্থ হন, এক্ষেত্রে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি (গ্রেস পিরিয়ড) করা যেতে হবে।

সাত. কোন জমি যেন অনাবাদি না থাকে সেজন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে বিশেষ করে আউশ ধান ও সবজি উৎপাদনের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।একইভাবে কোন খামার (হাস-মুরগি, গবাদি পশু বা মৎস্য) বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে তার যথাযথ কারণ নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করতে হবে।

আট. ইতিমধ্যে বোরো ধান উত্তোলন শুরু হয়েছে, কাজেই কৃষি শ্রমিকের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি, কাশি শিষ্টাচার ও যথাসম্ভব শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য কৃষিশ্রমিকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় পর্যায়ে স¦ল্প মূল্যে বা বিনামূল্যে কৃষি শ্রমিকদের মাঝে মাস্ক বিতরণ করা যেতে পারে। একইভাবে উৎপাদিত পণ্য (মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ধান, চাল, শাক-সবজি প্রভুতি) পরিবহন ও বাজারজাত করনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উৎসাহিত করতে হবে।

সুপারিশগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত কৃষি প্রণোদনা বাস্তবায়নের জন্য নীতিমালা বা নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে পারলে আকাঙ্খিত ফল পাওয়া যাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অন্যথায় এর খেসারত পুরো জাতিকে দিতে হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

লেখক: অধ্যাপক, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বাংংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

  •  
  •  
  •  
  •