বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস ২০২৫ ও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস

ড. মোঃ সহিদুজ্জামান

প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার পালিত হয় ‘বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস` । ২০২৫ সালের ২৬ এপ্রিল পালিত হতে যাচ্ছে এবারের দিবসটি। এবছর বিশ্ব ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন (WVA) যে প্রতিপাদ্য ঘোষণা করেছে তা হলো: ‘Animal Health Takes a Team` বাংলায় যার তাৎপর্য দাঁড়ায়: “প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রয়োজন দলগত প্রচেষ্টা”।

এই প্রতিপাদ্য শুধুমাত্র একটি স্লোগান নয়, বরং এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের আহ্বান। প্রাণিস্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে ভেটেরিনারিয়ান, প্যারাভেট, খামারি, গবেষক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক – সবার একসাথে কাজ করাই সময়ের দাবি।

প্রতিপাদ্যটি শুধুমাত্র ভেটেরিনারিয়ানদের নয়, বরং প্রাণিস্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট সব পেশাজীবীর সমন্বিত ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়। রোগ প্রতিরোধ, পুষ্টি নিরাপত্তা, খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণ, গবেষণা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারে এ ধারাবাহিক দলগত অংশগ্রহণই প্রাণিসম্পদ খাতের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের চাবিকাঠি।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ খাত কেবল একটি অর্থনৈতিক খাত নয় – এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, জনস্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের অন্যতম ভিত্তি। দেশের মোট জিডিপিতে এই খাতের অবদান প্রায় ১.৪৭ শতাংশ এবং প্রায় ২–৩ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই খাতের সঙ্গে যুক্ত।

তবে বাস্তবতা হলো, আমাদের অনেক খামার এখনও অলাভজনক বা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে। এর মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো – অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ঘাটতি, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং দলগত ব্যবস্থাপনার অভাব। এই প্রেক্ষাপটে এবারের প্রতিপাদ্যের গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনাটি হচ্ছে “একক প্রচেষ্টায় নয়, সম্মিলিত উদ্যোগেই প্রাণিস্বাস্থ্যের সুরক্ষা সম্ভব ।”

বাংলাদেশ একটি প্রাণিসম্পদ-নির্ভর উন্নয়নশীল দেশ। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রাণিজ আমিষের গুরুত্ব অপরিসীম। নিরাপদ দুগ্ধ, ডিম ও মাংস উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভেটেরিনারিয়ানদের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু তাই নয়, বর্তমান যুগে স্মার্ট লাইভস্টক ম্যানেজমেন্ট, জেনেটিক ইমপ্রুভমেন্ট, ডিজিটাল হেলথ, জেনোমিকস, ও টেলিভেটিনারি সার্ভিসে তাদের অংশগ্রহণ নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।

ভেটেরিনারি পেশার বহুমাত্রিকতা আজও অনেকের কাছে অজানা। জনসাধারণের মাঝে এখনও ভেটেরিনারিয়ানদের শুধু পশুর চিকিৎসক হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই পেশা অনেক বিস্তৃত ও গুরুত্বপূর্ণ। তারা খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ আমিষ নিশ্চিতকরণ, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও টিকাদান কর্মসূচি, ‘One Health’ উদ্যোগে অংশগ্রহণ, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও গবেষণা, আধুনিক প্রযুক্তি (AI, জেনোমিকস, বায়োটেক) প্রয়োগ, এবং খামার ব্যবস্থাপনা ও উদ্যোক্তা গঠনে সহযোগিতা করে থাকেন। বিশ্বজুড়ে যেমন, তেমনি বাংলাদেশেও আজকের ভেটেরিনারিয়ান একাধারে চিকিৎসক, গবেষক, শিক্ষক, পলিসি নির্ধারক ও উদ্যোক্তা।

ভেটেরিনারি ইকোনোমিক্স সময়ের দাবি। প্রাণিসম্পদ খাতকে লাভজনক ও টেকসই করতে হলে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণমূলক চিন্তা-চর্চার বিকল্প নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীই জানে না কিভাবে বাজার বিশ্লেষণ, খরচ-সুবিধা হিসাব, বিনিয়োগ বিশ্লেষণ করতে হয়। যেমন— FMD টিকার খরচ ৫০ টাকা হলেও এটি না দিলে দুধ উৎপাদন ৩০–৪০% কমে গিয়ে হাজার টাকার ক্ষতি হতে পারে। এই সরল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ খামারিরা জানলে আরও সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন।

“Veterinary Economics and Farm Management” বিষয়টি ভেটেরিনারি শিক্ষা ও চর্চায় আরও প্রয়োগমুখী করা দরকার। আমাদের দরকার অর্থনৈতিক চিন্তা-চেতনায় দক্ষ ভেটেরিনারিয়ান, যারা খামার ব্যবস্থাপনায় সঠিক পরামর্শ দিতে সক্ষম হবেন।এজন্য ভেটেরিনারি কারিকুলামে “ভেট ইকোনোমিক্স”প্রয়োগমুখীভাবে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। পাশাপাশি জাতীয় পর্যায়ে একটি ভেট ইকোনোমিক্স গবেষণা ইউনিট গঠন, খামারিদের জন্য অর্থনৈতিক সাক্ষরতা প্রশিক্ষণ এবং একাডেমিয়া-গভর্নমেন্ট-ইন্ডাস্ট্রি পার্টনারশিপে বাজার বিশ্লেষণ কেন্দ্র স্থাপন সময়ের দাবি।

শিক্ষা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি খাতে দক্ষতা অর্জন অত্যন্ত জরুরি। আধুনিক যুগের ভেটেরিনারিয়ানদের স্মার্ট লাইভস্টক ম্যানেজমেন্ট, ডিজিটাল হেলথ সেবা, র‌্যাপিড ডায়াগনস্টিক কিট, জেনেটিক ইমপ্রুভমেন্ট, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও অটোমেশন ব্যবহারে দক্ষ হতে হবে। তরুণদের জন্য মোবাইল ক্লিনিক, ফিড মিল, ওষুধ উৎপাদন, টেলিভেট সেবা ও স্টার্টআপ ইনোভেশনের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়াও ফিড ফর্মুলেশন, স্মার্ট সেন্সর ব্যবহার, বায়োটেকনোলজি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মতো ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তারা উদ্যোক্তা, ফার্ম ম্যানেজার কিংবা গবেষক হিসেবে আত্মনিয়োগ করতে পারে, যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি আত্মনির্ভর বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক হবে।

Covid-19 পরবর্তী সময়ে One Health ধারণা নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে। আমরা জানি, মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্য একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যেসব রোগ মানুষ ও প্রাণী উভয়ের মাঝে ছড়াতে পারে (Zoonotic diseases), যেমন— র‌্যবিস, ব্রুসেলোসিস, যক্ষ্মা – এসব রোধে দলগতভাবে চিকিৎসক, ভেটেরিনারিয়ান ও পরিবেশবিদদের একত্রে কাজ করাই সবচেয়ে কার্যকর।

বাংলাদেশে One Health Institute প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। বর্তমান বৈশ্বিক ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে One Health ধারণা আর শুধু তাত্ত্বিক বিষয় নয়, এটি এখন বাস্তব প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে One Health Institute প্রতিষ্ঠা সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ হতে পারে, যা গবেষণা, শিক্ষা, নীতি-পরিকল্পনা এবং মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমে সমন্বয় আনবে। এই ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে zoonotic রোগ নিয়ন্ত্রণ, দলগত কাজে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা, পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংরক্ষণ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব। একইসঙ্গে এটি শিক্ষার্থী, গবেষক, ভেটেরিনারিয়ান, চিকিৎসক ও নীতিনির্ধারকদের এক প্ল্যাটফর্মে এনে One Health চর্চাকে বাস্তবিক রূপ দিতে সাহায্য করবে।

বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস ২০২৫ আমাদের জন্য শুধুই একটি দিবস নয় – এটি আত্মজিজ্ঞাসার, মূল্যায়নের এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার একটি মোক্ষম সময়। বাংলাদেশে প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষায় বাস্তবসম্মত, উদ্ভাবনী ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই দলগত প্রচেষ্টাই হতে পারে আমাদের আগামী দিনের আশার আলো।

প্রাণিস্বাস্থ্য রক্ষার লড়াই একা লড়ার বিষয় নয়, এটি একটি টিমওয়ার্ক। এই উপলক্ষে আমাদের প্রয়োজন বাস্তবমুখী শিক্ষা, অর্থনৈতিক চর্চা, প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা, গবেষণাভিত্তিক নীতিনির্ধারণে সহায়তা এবং সমাজে ভেটেরিনারিয়ানদের অবদানকে যথার্থ স্বীকৃতি প্রদান। তাহলেই আমরা গড়ে তুলতে পারি একটি স্বাস্থ্যবান, পুষ্টিসম্পন্ন ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই বাংলাদেশ।

লেখকঃ অধ্যাপক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

  •  
  •  
  •  
  •