শিক্ষার্থীর ৭১% শিক্ষার ব্যয় বহন করে তার পরিবার

নিউজ ডেস্ক: এক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে মোট খরচের ৭১ শতাংশ বহন করে শিক্ষার্থীদের পরিবার। পরিবারপিছু খরচের বিবেচনায় এই হার বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ইউনেসকো পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।
গত মঙ্গলবার ঢাকা ও প্যারিস থেকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেসকোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট এবং ব্র্যাকের উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়।
শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারগুলোর প্রতি পাঁচ দফা সুপারিশ রেখেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বেসরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবারপিছু শিক্ষা ব্যয়। প্রাক-প্রাথমিক স্তরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আধিক্য পরিবারগুলোর শিক্ষা ব্যয়ের বোঝা বাড়িয়েছে। শিক্ষা খাতে অপর্যাপ্ত বরাদ্দ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতের পথে প্রধান অন্তরায়। গত দশকে বাংলাদেশ সরকার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আড়াই শতাংশের কম খরচ করেছে শিক্ষা খাতে, যা জাতিসংঘের সুপারিশ করা ৪ শতাংশ সীমার অনেক নিচে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশের ৫৫ শতাংশ শিশু প্রাক-প্রাথমিক স্তরে বিভিন্ন ধরনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়। প্রাথমিক স্তরে মোট বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হার ২২ শতাংশ, সংখ্যায় ২৯ হাজার। মাধ্যমিক পর্যায়ে এই হার ৯৪ শতাংশ, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
কারিগরি ও ভোকেশনাল পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আধিক্য সর্বোচ্চ। ২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে এ খাতের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণ। ছয় হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে মাত্র ৯০০টি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রাক-প্রাথমিক স্তরে অধ্যয়নরত ২০ শতাংশ শিশুর গৃহশিক্ষক রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে গৃহশিক্ষক বাবদ খরচ ২০০০ সালের ২৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১০ সালে ৫৪ শতাংশ হয়েছে। শহরাঞ্চলে এই খরচ ৪৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য ইউনেসকোর প্রতিবেদন বলছে, মানের দিক থেকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে বেসরকারি খাতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৯৪ শতাংশ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গ্রেড অর্জন করে থাকে। বিপরীতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাত্র ৩৬ শতাংশ একই উচ্চতায় পৌঁছতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে সিভিল সোসাইটি ইনস্টিটিউশন বা বেসরকারি সংস্থাগুলোর অবদানের সুবিধা স্বীকার করা হলেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করতে পারেনি। এনজিও পরিচালিত স্কুলগুলোর ফি সরকারি স্কুলের তুলনায় তিন গুণ বেশি, যার কারণে এসব স্কুলের সুফল দরিদ্রতম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে না।
সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে অসন্তোষের কারণে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি বাড়ছে বলে গবেষণায় দাবি করেছে ইউনেসকো। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর অতিরিক্ত চাপ এবং শিক্ষা-প্রযুক্তি কম্পানিগুলোর বিকাশ বেসরকারি শিক্ষার প্রসারে ভূমিকা রাখছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে শিক্ষকরাও মূলত বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়ই প্রশিক্ষিত, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোর ৬০ শতাংশই বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। সরকারি ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত ও মানসম্মত প্রশিক্ষণের ঘাটতির ফলেই বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজমুখী হচ্ছেন শিক্ষকরা। মাধ্যমিক পর্যায়ের ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষক তাঁদের বিএড ডিগ্রি নিয়েছেন বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ থেকে। দেশের বেসরকারি খাতের শিক্ষকদের সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মাসিক পে-অর্ডার (এমপিও) ব্যবস্থায় অপর্যাপ্ততা এবং অসম বণ্টনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে।
ইউনেসকোর প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালগুলোর ৪২ শতাংশই বেসরকারি। এ অঞ্চলের ৩৮ শতাংশ শিক্ষা ব্যয়ের জোগান আসে পরিবার থেকে, যা বিশ্বের অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় সর্বোচ্চ।