এক নজরে ডিসেম্বর, ২০২১
এস এম আবু সামা আল ফারুকী:
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। বিজয়ের এই মাসে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনায় মাসটি দেশবাসীর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ডিসেম্বর মাসের শুরু হয় অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে। বোমা আতঙ্ক দেখা দেওয়ায় ঢাকার হয়রত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী একটি ফ্লাইট জরুরি অবতরণ করে। তবে পরবর্তীতে ফ্লাইটটি থেকে কিছু পাওয়া যায়নি।
১ ডিসেম্বর দিনটি বেসরকারীভাবে মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে পালন করে আসছেন প্রতিবছর। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস চেতনা পৌছিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধারা এই দিনটিকে সরকারীভাবে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবী জানিয়ে আসছে সংগঠনটি। তবে ১ ডিসেম্বরকে ‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার সুপারিশ করেছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
৬ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক গণতন্ত্র মুক্তি দিবস। এদিন তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দীর্ঘ নয় বছরের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পতন ঘটে এরশাদের। দিবসটি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন পৃথক কর্মসূচির আয়োজন করে।
৮ ডিসেম্বর-চাঞ্চল্যকর আবরার হত্যার রায় ঘোষনা করা হয় এদিন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন।
৯ ডিসেম্বর পালিত হয় বেগম রোকেয়া দিবস। বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ১৪১তম জন্ম এবং ৮৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর এদিন সারা দেশে সরকারিভাবে রোকেয়া দিবস পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে ঢাকা ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে সেদিন সকাল ১০টায় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রোকেয়া পদক ২০২১ প্রদান করা হয়। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্জন, উপকৃত সকল জনগণ- এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ১২ ডিসেম্বর জেলা-উপজেলা এবং বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে উদযাপিত হয়েছে ‘জাতীয় ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস ২০২১’।
১০ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক ময়মনসিংহ মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদার বাহিনীদের পরাজিত করে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা মুক্ত করেছিল এই ময়মনসিংহকে। এই দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, খুশির, আনন্দের এবং মুক্তির দিন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ভাষণের পর থেকে ২২ এপ্রিল পর্যন্ত ময়মনসিংহকে দখলমুক্ত রেখেছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তবে ২৩ এপ্রিল ময়মনসিংহের পতন ঘটলে শহর ছেড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তসহ সীমান্তের ওপারে চলে যায় মুক্তিযোদ্ধারা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি ভবনে স্থাপন করা হয় পাক হানাদার বাহিনীর বিগ্রেড হেড কোয়ার্টার। হানাদারদের সহযোগী হিসাবে গড়ে তোলা হয় আলবদর, আল সামস, রাজাকার বাহিনী। জেলা পরিষদ ডাক বাংলোটির “শান্তি ভবন” নাম দিয়ে টর্চার সেল ও কিলিং সেন্টার গড়ে তোলে। তাছাড়া ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ ও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে গড়ে তোলা হয় আরও ২টি আস্তানা। এছাড়াও অবাঙ্গালী বিহারিরা শহরের ছোট বাজারে গড়ে তোলে “কিলিং জোন”। ৭১ এ পাক সেনা আর রাজাকার, আল বদররা এসব আস্তানায় বাঙ্গালী নিধনে মেতে উঠেছিল। প্রতিদিনের সেই নৃশংসতার নিদর্শন দেখা যেত ব্রহ্মপুত্রের চরে। মুক্তাগাছা, গৌরীপুর ও নান্দাইলের এই নৃশংসতার মাত্রা ছিল ভয়াবহ। প্রায় ৭ মাস পাক সেনাদের দখলে থাকার পর নভেম্বরের শেষের দিকে একের পর এক মুক্ত হতে থাকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন উপজেলা। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নেত্রকোনা থেকে একটি গ্রুপ অগ্রসর হয় ময়মনসিংহের দিকে। একই সময় হালুয়াঘাট, ফুলপুর হয়ে মিত্র বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেক একটি দল অগ্রসর হয় শহরে অভিমুখে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে শহরে কারফিউ জারি করে হানাদাররা। অপরদিকে টাঙ্গাইল হয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যায় পাক সেনারা। পরবর্তীতে ১০ ডিসেম্বর সকালে বিজয়ের বেশে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন ঢালু যুব শিবির প্রধান বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান এবং মিত্রবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন বিগ্রেডিয়ার সামস শিংহ বাবাজি। ১০ ডিসেম্বর সার্কিট হাউজ মাঠে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মো. মতিউর রহমান। মিত্রবাহিনীর কমান্ডার বাবাজির নেতৃত্বে শহরে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ থেকে হানাদার মুক্ত করেন।
১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। ১৯৭১ সালের এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস পরিকল্পনা করে দেশের বুদ্ধিজীবীদের ওপর এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। হত্যা করে দেশের সূর্য সন্তানদের। বাংলাদেশকে চিরদিনের জন্য মেধাশূন্য করার অপচেষ্টায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। পরবর্তীতে ১৪ ডিসেম্বরের কলঙ্কজনক এই দিনটিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে প্রতিবছর পালন করা হচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। মহাসমারোহে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হয় এদিন। বাঙালির মহাবিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় সঙ্গী হয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা বন্ধুদেশ ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সেদিন বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে সারা দেশের মানুষকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।