গবেষণায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

গোলাম রববিল, রাবি প্রতিনিধি:

১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই স্যাডলার কমিশনের সুপারিশে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালে মাত্র ১৬১ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। সাথে দেশের উত্তরাঞ্চলের মাত্র ১২টি ডিগ্রি কলেজ এবং আটটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ অধিভুক্ত করে সাতটি বিভাগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। গুটি গুটি পায়ে ১৬১ শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন প্রায় ৪০ হাজারে পৌঁছে গেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সকল আন্দোলনে অনুকরণীয় অবদান রাখা বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন ৬৮ বছর পার করে ৬৯- এ পা দিয়েছে।

শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে এরই মধ্যে লাভ করেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। হয়েছে দেশের সেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞান গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি করা সিমাগো-স্কপাসের ২০২০ সালের ইনস্টিটিউশনস র‌্যাংকিংয়ে জায়গা পাওয়া ১৯ দেশের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল শীর্ষে।

যে সকল কৃতি গবেষকরা তাদের গবেষণা দারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে গেছে এক অনন্য অবস্থানে আমরা তাদের মধ্যে অন্যতম কিছু গবেষণা ও গবেষক হলো-

মসলিন পুনরুদ্ধার:
প্রায় ১৭০ বছর পর আবার বাংলাদেশে বোনা হলো ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই মসলিন। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশের একদল গবেষক দীর্ঘ ছয় বছর গবেষণা করে সক্ষম হয়েছেন ঢাকাই মসলিন তৈরিতে। প্রাথমিকভাবে তৈরী হয়েছে ছয়টি মসলিন শাড়ি।

বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ঢাকাই মসলিন তৈরিতে বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ১৮জন গবেষক কাজ করেছেন। এ গবেষণা দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনজুর হোসেন।

অধ্যাপক মনজুরের গবেষণা:
উল্লেখ্যযোগ্য গবেষকের মধ্যে আছেন উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুর হোসেন। জাপানের গবেষকদের সাথে একযোগে কাজ করে কম খরচে পানিকে আর্সেনিক দূষণমুক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন তার গবেষক দল। জাপানের তৈয়মা বিশ্ববিদ্যলয়ের ওয়াটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. তমুনুরি কাওয়াকামির সঙ্গে উদ্ভাবিত ওই প্রযুক্তির নাম ‘রিমোভাল অব আর্সেনিক থ্রু ইলেক্ট্রনিক সিস্টেম’। স্থানীয় উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়েছে প্রযুক্তিটি।

এদিকে বাজারজাতকরণের উপযোগী কাঁচা মরিচের গুঁড়ো তৈরি করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক। দুই বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় উদ্ভাবিত এই গুঁড়ো ব্যবহার করা যাবে কাঁচা মরিচের বিকল্প হিসেবে। কোনো ধরনের রাসায়নিক ছাড়াই তৈরি গুঁড়োর রং, ঘ্রাণ, স্বাদেরও কোনো পরিবর্তন হয়নি। গবেষক এর নাম দিয়েছেন ‘গ্রিন চিলি পাউডার’।

এছাড়া দীর্ঘদিন গবেষণার পর তিনি সজনে গাছের পাতা প্রক্রিয়া করে এক ধরনের গুঁড়া তৈরিতে সক্ষম হন। তার উদ্ভাবিত এ পাউডারটি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ৩-৫ গ্রাম বা এক চা চামচ পরিমাণ গুঁড়া পানির এক গ্লাস পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলেই পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’সহ বিভিন্ন পুষ্টিগুণ পাবে মানবশরীর।

মূলত একজন কৃষি গবেষক অধ্যাপক মনজুর হোসেন। আমের হিমাগার তৈরি ও রাজশাহী অঞ্চলে স্ট্রবেরি চাষের উপযোগী প্রজাতি উদ্ভাবনেও সফলতা পেয়েছেন এই গবেষক। এছাড়া মিশরের একটি প্রাচীণ তুলার সন্ধান পেয়েছেন তার গবেষকদল।

হাওড়ে ফিরছে ৮ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশী মাছ:
দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্ত রক্ষায় কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের একদল গবেষক। প্রায় ৮ টি দেশী প্রজাতির মাছ হাওড়ে মজুদ করতে সক্ষম হয়েছেন বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসেনের নেতৃত্বে গবেষণাকরা একটি দল। হাওড়ে দেশীয় প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনতে চলমান একটি প্রকল্পের সফলতা এটি। দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো ফেরানো যাবে বলে সম্ভাবনার কথা বলছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষকদল। এছাড়া কাজ করছেন হাওড় নির্ভর ৮৪ হাজার মানুষের জাবীনযাত্রার ব্যপক পরিবর্তনের আশায়। বিলুপ্তির পথে থাকা দেশীয় মাছের প্রাচুর্যতা ফিরিয়ে আনাসহ হাওড়ের জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, হাওড় সংলগ্ন জনগোষ্ঠীর উপার্জন ও পুষ্টিচাহিদা পূরণে গবেষণা চলা এই প্রকল্পের সহকারী প্রকল্প পরিচালক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. ইয়ামিন হোসেন।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৯ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ চলছে ঝিনাইদহের সার্জাত ও সাগান্না এই দুটি হাওড়ে। হাওড়ে ফেরা দেশী মাছগুলো হলো- কই, শিং, দেশী মাগুর, পাবদা, গুলশা টেংরা, ছোট টেংরা, বাজারী টেংরা এবং টাকি পার্শ্ববর্তী বিল এবং নদী হতে সংগ্রহ করে হাওড়ে মজুদ করা হয়েছে। হাওড়ে ফেরা মাছগুলো ডিম দিচ্ছে এবং বৃদ্ধি লক্ষ্য করেছেন গবেষকরা।

৫০ টি প্রজাতির দেশী মাছ ২০ থেকে ৩০ বছর আগেও সেগুলো সচারচর নদী নালা, খাল বিল ও হাওড়গুলোতে পাওয়া যেতো। জলবায়ু পরিবর্তন ও কিছুটা মানবসৃষ্ট কারণে হুমকির মুখে পড়া দেশী মাছের অস্তিত্ব, ইতিমধ্যে স্থানীয়ভাবে বিলুপ্ত হওয়া মাছগুলো হাওড়ে ফিরবে ২০২২ এর মধ্যে আশাবাদি গবেষকরা। প্রজেক্ট শেষে শতভাগ সফলতা পাওয়া গেলে হাওড়ে স্থায়ীত্ব পাবে এসব মাছ। এবং এতে দেশী মাছের জিনব্যাংক ও ব্রুড ব্যাংক রূপ নিবে হাওড়গুলো। এর ফলে দেশের কোথাও না পাওয়া গেলেও ওখানে পাওয়া যাবে এবং হ্যাচারিগুলোতে মা মাছ নিয়ে গিয়ে ডিম ফুটাতে পারবেন। এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত হাওড়গুলোতে বার্ষিক গড় মৎস্য উৎপাদন ৭,৭২৯ মেট্রিক টন দেশী মাছ উৎপাদন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া ইলিশ ধরার সময় পুনর্গঠনের জন্যও কাজ করছেন এই গবেষক। সেই সাথে কাজ করছেন সামুদ্রিক মাছ ও মাছের খাদ্য ও বাসস্থানের বিষয়ে।

দেশের প্রথম সাপের বিষের ডাটাবেজ:
দেশের একমাত্র ও প্রথম সাপের বিষের ডাটাবেজ তৈরি করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবু রেজা। দেশের অভ্যন্তরে পাওয়া সাপগুলোর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নাম, খাদ্যাভ্যাস, প্রকার, প্রকৃতিসহ জীবনবৃত্তান্ত বিস্তারিত স্থান পেয়েছে সেখানে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই অধ্যাপক বাংলাদেশে পাওয়া বিভিন্ন প্রজাতির বিষাক্ত সাপ ও তার প্রত্যেকটির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন ডাটাবেজে। এছাড়া বিষাক্ত সাপগুলোর মধ্যে কী কী ধরনের বিষ এবং সেই বিষের গঠন আছে। ২০১৩-১৪ সালের দিকে এই ডাটাবেজ তৈরির কাজ শুরু করেন অধ্যাপক রেজা। প্রতিষ্ঠিত এই ডাটাবেজের নাম স্নেকবিডি.কম।

সেখানে , কালনাগিনী, গোখরা, কালো হলুদ ব্যান্ড লাঠি, মোহনার লাঠি, শঙ্খীনি, ধামান, পাথরসহ প্রায় ৮৯টি সাপের বিষের বিস্তারিত তথ্য রয়েছে। কোন সাপের কামড়ে কী ধরনের ভেনোম ব্যবহার করা যাবে, কত ধরনের ভেনোম আছে তার সবই আছে সেখানে। গত প্রায় ৯ বছর ধরে সাপের বিষের উপর গবেষণা করছেন এই গবেষক। নির্দিষ্ট ভেনোম বের করতে কঠিন হয় বলেই এই উদ্যোগ তার। ডেটাবেজে গিয়ে যদি কার্ডিওটক্সিন খুজে পেতে খুব সহজ হবে। প্রায় ৩ শতাধিক সাপের ভেনোমের প্রোটিন বিশ্লেষণ করে একটা কাঠামো দেখিয়ে দেওয়া এই ডাটাবেজ জীবতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য গবেষকদের সহজলভ্য এটি। যা সাপ নিয়ে গবেষকদের গবেষণায় সহায়তা করবে বলে আমার বিশ্বাস। শুধু বাংলাদেশ নয়, বলতে গেলে পৃথিবীতেই এই ধরনের ডাটাবেজ প্রথম।

গেছো শামুকের ক্যাপ্টিভ প্রজননে রাবি:
২০২০ এর নভেম্বরে ‘প্রকৃতির মুক্ত’ খ্যাত গেছো শামুকের ক্যাপ্টিভ প্রজননে সাফল্য পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল। বিশে^র প্রথম গেছো শামুকের ক্যাপ্টিভ প্রজনন করতে সক্ষম হলেন তারা। বছরের মার্চে শামুকটি নিয়ে গবেষণা শুরু হওয়ার ৯ মাসের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার শোভনের হাত ধরে এই গবেষণার সাফল্য আসে।

শামুকটির আদি নিবাস আমেরিকার ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্য হলেও পাওয়া গেছে রাজশাহী অঞ্চলে। লিগ্যাস প্রজাতির হতে পারে ধারনা করছেন ওই গবেষকদল।

২০১৮ থেকে দেশের জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন রাবির এই অধ্যাপক। তার অংশ হিসেবে এই শামুক সংরক্ষণে এগিয়ে এসেছেন তিনি ও তার গবেষকদল। এছাড়া একটি নতুন শামুকের সন্ধ্যান পেয়েছেন তারা। এর আগে হাওয়াইতে ডেভিসসিসকো নামের একজন গবেষক সাধারণ শামুকের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা পান।

পদার্থবিদ্যায় রাবি গবেষক:
এমএসসির থিসিসের মাধ্যমে ১৯৬৩ সালে গবেষণার ভুবনে প্রবেশ করেন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. অরুন কুমার বসাক। তাঁর সুপারভাইজর ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক আহমদ হুসেন। ক্ষেত্র ছিল কণাবিজ্ঞান। এক বছরের মাথায় ফলাফল পেয়েছিলেন। থিসিস পেপারটি ১৯৬৪ সালের ২৭ আগস্ট চীনের চায়না সিম্পোজিয়ামে প্রথম উপস্থাপন করা হয় এবং খুব প্রশংসা লাভ করে। নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তিনি। সেখানে প্রোটন, নিউট্রন, হিলিয়াম থ্রি ইত্যাদি কণার আচরণ সম্পর্কে তিনি গবেষণা করেছেন। দেশে ফিরে ১৯৯৭ সাল থেকে নিউট্রন স্টার নামে এক ধরণের তারা যেগুলো থেকে আলো বের হয় না, সেগুলোর স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে গবেষণা করেছেন। সূর্য যে আমাদের আলো দিচ্ছে, এটিও একদিন নিউট্রন স্টার হয়ে যাবে। দেশের একমাত্র গবেষক হিসেবে ড. অরুণ কুমার বসাক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে এই প্রজেক্টে গবেষণা করেছেন। প্রথম ধাপে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সালের জুলাই এবং পরে ২০০২ সালের আগস্ট থেকে ২০০৮ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত যে গবেষণাকর্ম চালিয়েছেন, তার ফলাফল নিয়ে ৩৩টি আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র লিখেছেন। সেগুলো ইংল্যান্ডের ইন্সটিটিউট অব ফিজিকস [আইওপি] ও যুক্তরাষ্ট্রের ফিজিক্যাল সোসাইটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এখন তাঁর অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক আলফাজউদ্দিন অ্যাটমিক ফিজিকস ও নিউক্লিয়ার ফিজিকস নিয়ে গবেষণা করছেন। এছাড়াও এ পর্যন্ত তিনি ৫৫টি এমএসসি, দুটি এমফিল ও ছয়টি পিএইচডি থিসিসের তত্ত্বাবধায়ক। দেশি-বিদেশি জার্নালে তাঁর ১৩৯টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। অনার্স লেভেলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তাঁর লেখা ‘ব্যবহারিক পদার্থবিজ্ঞান’ বইটি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে।

ড. অরুণ কুমার বসাক ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ছিলেন। ১৯৯০-৯৪ সাল পর্যন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ছিলেন। ২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া এই মানুষটি শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে অসামান্য অবদানের জন্য ২০০৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে দেশের একমাত্র প্রফেসর ইমেরিটাস সম্মাননায় ভূষিত হন। তাঁর নামে ২০০৭ সাল থেকে পেনিনসুলা ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট প্রফেসর বসাক পুরস্কার ও বৃত্তি চালু করেছে। প্রতিবছর এখান থেকে চার মেধাবীকে বৃত্তি ও দুজনকে ক্রেস্ট ও আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়।

অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের একজন অন্যতম গবেষক। পদার্থ বিজ্ঞানের থিওরি গবেষণায় বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান তার।

পাটের বিকল্প আঁশ উদ্ভাবন:
পাটের বিকল্প সোনালি আঁশ উদ্ভাবন করার সাফল্যও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। পাট ছাড়াই বিকল্প উপায়ে সোনালি আঁশ পাওয়ার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম। উদ্ভাবিত এই আঁশ খুবই আরামদায়ক ও শক্ত বা স্থায়িত্বশীল। পাট থেকে পাওয়া আঁশের চেয়েও কিছুটা উজ্জ্বল। ফলে তা দিয়ে তৈরি পোশাকও হবে অনেক বেশি উজ্জ্বল। ঝোপ-ঝাড়ে কিংবা পতিত স্থানে কম খরচে তুলনামূলক পরিচর্যা ছাড়াই জন্মায় এমন এক ধরনের উদ্ভিদ থেকে এই আঁশ পাওয়া যাবে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হলে ব্যাপকভাবে টেক্সটাইল এবং রেডিমেড গার্মেন্টস শিল্পে ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশ ফার্মাসি কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক ড. আনওয়ারুল ইসলাম এবং ফার্মাসিউটিক্যাল জার্নালের চিফ অব ইকোনমিক ডিরেক্টর। তিনি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্সারবিরোধী গবেষণার সঙ্গেও জড়িত।

আর্সেনিক দূষণ ও স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে গবেষণা:
গত ১ যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ‘পরিবেশ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান’ গবেষণাগারে আর্সেনিক বিষক্রিয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে রোগ সৃষ্টিতে আর্সেনিকের প্রভাব ও দেশে আর্সেনিকের ভয়াবহতাসহ নানা তথ্য। ২০০৭ সালের শেষের দিকে বিভাগের তরুণ গবেষক অধ্যাপক ড. খালেদ হোসেনের হাত ধরে যাত্রা শুরু করে গবেষণাগারটি। গবেষণাগারের গবেষক ও গবেষণা সমন্বয়কারী চিকিৎসকরা সাধ্যমতো জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি ও প্রয়োজনে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। গবেষকদল চেষ্টা করেন, আর্সেনিক আক্রান্তদের সাধ্যমতো সেবা দিতে।

এ গবেষণাগারের অনেক গবেষণা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন অধ্যাপক খালেদ হোসেন।

সুস্থ মানুষের লালায় এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধি শক্তিশালী জিন:

প্রতিবছর বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ মানুষ ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট’ জীবাণুঘটিত সংক্রমণের কারণে মৃত্যুবরণ করছেন। দিনদিন বাড়তে থাকা এই সংখ্যা কমতে পারে বলে সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা।

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা সুস্থ মানুষের মুখের লালায় এমন একটি জিনের সন্ধান পেয়েছেন, যা যক্ষ্মা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডি-সাইক্লোসেরিন’ নামের একটি শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতাকে নষ্ট করে দিতে পারে। ‘ডি-অ্যালানিন-ডি-অ্যালানিন লাইগেজ’ নামক এই জিনটি প্রথমবারের মতো ইন্টেগ্রন জিন ক্যাসেট নামক এক ধরনের ক্ষুদ্র ভ্রাম্যমাণ জেনেটিক উপাদানের মধ্যে শনাক্ত হয়। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের দুটি আলাদা আলাদা নমুনা সেটের প্রায় সব সুস্থ স্বেচ্ছাসেবকের লালায় এই ভ্রাম্যমাণ জিনের সন্ধান পেয়েছেন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ, কিংস কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। এ গবেষণা সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা নেইচার রিসার্চ কর্তৃক প্রকাশিত ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজে মাইক্রোবিয়াল ডিজিজেস বিভাগে প্রায় ৩ বছর আগে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে ড. অ্যাডাম রবার্টস ও প্রফেসর পিটার মুলানীর তত্ত্বাবধানে এ গবেষণাটির মূল কাজ সম্পন্ন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আজিজুর রহমান। তার পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসেবে এ গবেষণাটি প্রকল্পটি সম্পন্ন হয়।

শুধু গবেষণায় সাফল্য দেশের গণ্ডিতে নয়। ভালো গবেষণার কারনে স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অনেক শিক্ষার্থী। গত কয়েকদশকে এই সংখ্যাটা বেড়েছে। প্রতিবছর অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী গবেষণার সুযোগে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। শুধু একটি ল্যাব থেকেই গত এক দশকে প্রায় বিশজনের বেশি গবেষক গবেষক উন্নত গবেষণার জন্য বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন সেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। উত্তরাঞ্চলের বিদ্যাপিঠ হলেও প্রতিনিধিত্ব করছে পুরো দেশকে। এই ধারা অব্যাহত রেখে শত বছর পূর্তি করবে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রত্যাশা সকলের।

  •  
  •  
  •  
  •