সাতক্ষীরায় ব্যতিক্রমী রঙিন মাছ চাষে সাফল্য
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি:
সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার বজ্রবক্স গ্রামের জেসমিন সুলতানার স্বামী সাইফুল্লাহ গাজী ছিলেন গার্মেন্টকর্মী। কাজ করতেন রাজধানীর মিরপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানায়। মাস শেষে যা টাকা বেতন পেতেন, তা থেকে বাসা ভাড়া দেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা দিয়ে সংসার চলত না।
একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলেন মাছ চাষের। ফিরে এলেন গ্রামে। পরেশ নামে এক বন্ধু রঙিন মাছের চাষ করতেন। তার কাছ থেকে ছয় জোড়া ব্রড মাছ (অ্যাকুরিয়ামের জন্য রঙিন মাছ বিশেষ) সংগ্রহ করে শুরু করলেন চাষ। সেই ছয় জোড়া মাছ এক যুগ পর এখন কয়েক লাখে গিয়ে ঠেকেছে। সাইফুল্লাহ-জেসমিন দম্পতির মূলধন এখন ২০ লাখ টাকা।
এখন তার লিজ নেওয়া পুকুরের সংখ্যা ১৬টি। এসব পুকুরে বিভিন্ন জাতের রঙিন মাছের পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। কর্মসংস্থান হয়েছে ২০ জন শ্রমিকের।
জেসমিন সুলতানা বললেন, ২০০৪ সালে মাত্র ছয় জোড়া পোনা মাছ দিয়ে চাষ শুরু করি। ব্যবসা বাড়াতে তখন হাতে টাকা ছিল না। পরে ঢাকা আহছানিয়া মিশন থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মাছ চাষ সম্প্রসারণ শুরু করি। এখন আমি একজন সফল উদ্যোক্তা। তিনি বলেন, আমার মাছের খামার থেকে ঢাকার কাঁটাবন, খুলনা ও রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রঙিন মাছ যাচ্ছে।
রঙিন মাছ চাষ কেবল সাতক্ষীরা অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ না। ফেনী, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুরেও বাণিজ্যিকভাবে রঙিন মাছের চাষ হচ্ছে। এ ছাড়া অনেকে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বাসার ছাদেও রঙিন মাছের চাষ করে তা বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করছেন।
রঙিন মাছের জন্য দেশের সবচেয়ে বড় বাজার হলো রাজধানীর কাঁটাবন। অ্যাকুরিয়ামের জন্য রঙিন মাছ আগে পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। এখন দেশের বিভিন্ন প্রজাতির রঙিন মাছ উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে ধীরে ধীরে সেই বিদেশনির্ভরতা কমে এসেছে। আর দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় শৌখিন মানুষ দেশীয় রঙিন মাছের দিকেই ঝুঁকছে। বাংলাদেশে অ্যাকুরিয়ামে রঙিন মাছ ব্যাপক জনপ্রিয়। শৌখিন মানুষ বাসা-বাড়িতে সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য অ্যাকুরিয়াম রাখেন। শপিংমল, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এমনকি দোকানেও এখন অ্যাকুরিয়ামের ব্যবহার বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলেন, অ্যাকুরিয়াম আগে উচ্চবিত্তদের বাড়িতে বেশি দেখা যেত। সময় পাল্টেছে, এখন মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তরাও শখের বশে বাসা-বাড়িতে অ্যাকুরিয়াম রাখেন। দিন যত যাচ্ছে এর ব্যবহারও ততই বাড়ছে।
তারা বলেন, দেশে উৎপাদনের সুবাদে অ্যাকুরিয়ামের রঙিন মাছ আমদানি এখন অনেকটাই কমে এসেছে। এই খাতে দেশ ধীরে ধীরে স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে। এটি বড় একটি সুখবর। কারণ আমরা চাই দেশের টাকা দেশেই থাকুক। তারা জানান, এখন অনেক শিক্ষার্থীও রঙিন মাছ উৎপাদন করে তাদের কাছে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করে। এতে করে শিক্ষার্থীরাও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখছে।
সাইফুল্লাহ গাজী নামে আরেক মাছ ব্যবসায়ী জানান, পুকুরের পরিবেশ একটু ভালো রাখলে, চুন ব্যবহার করলে, স্বচ্ছ পানি থাকলে এবং জীবাণুমুক্ত পানি হলে সেখানে রঙিন মাছ উৎপাদন করা যায়। কিচিং গোরামি, মিল্কি কই কার্প, কই কার্প ও কমিটিসহ ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির রঙিন মাছ উৎপাদন হয় । প্রতিটি মাছের দাম সর্বনিম্ন ১০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। তিনি বলেন, সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণ পেলে এ ব্যবসা আরো সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটু সহযোগিতা পেলে ব্যাপকভাবে চাষ করে রঙিন মাছ বিদেশে রপ্তানিরও সুযোগ রয়েছে।
বিদেশ থেকে রঙিন মাছ আমদানিকারক পপুলার অ্যাকুরিয়াম সেন্টারের অংশীদার শহীদুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর থেকে রঙিন মাছ আমদানি করা হয়। আগে মাসে ১০০ রঙিন মাছের কার্টন আমদানি করতেন। এখন ৩০ থেকে ৪০ কার্টন মাছ আমদানি করছেন। কারণ দেশেই এখন রঙিন মাছ উৎপাদন হচ্ছে। দামও তুলনামূলক অনেক কম।
তিনি বলেন, বিদেশের এক জোড়া গোল্ড ফিশের দাম পড়ে দুই হাজার টাকা। চিংড়ির জোড়া ৬০০ টাকা। এর বেশি দামও আছে। তা ছাড়া ওই সব রঙিন মাছের খাবারের দামও বেশি। তাই মানুষ এখন দেশে উৎপাদত রঙিন মাছ বেশি কিনছে।
আরেক মাছচাষি শহিদুল ইসলাম জানান, দেশে অ্যাকুরিয়াম ও রঙিন মাছের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আগে রাজধানীতে ৩৪টি দোকান ছিল। এখন দোকানের সংখ্যা শতাধিক।
You must be logged in to post a comment.