শ্রীলঙ্কার বেহাল অবস্থার কারণ

নিউজ ডেস্কঃ

খাদ্য ও জ্বালানি সঙ্কট

ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইতোমধ্যে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে প্রায় ৭০ শতাংশ কমেছে। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ছিল। এমনকি বছরের বাকি সময়ে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।

দেশটির এখন যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে কেবল কয়েক সপ্তাহের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে।

বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির অর্থ হল, দেশটি জ্বালানি, খাদ্য এবং ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি এবং মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে সংগ্রাম করছে।

ডয়চে ভেলে লিখেছে, এই সঙ্কটের ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। দিনে মাত্র চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে এবং ফিলিং স্টেশনগুলোর বাইরে লম্বা লাইন তৈরি হয়েছে।

জ্বালানি সঙ্কটে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না। পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর জলাধারের পানি বিপজ্জনক মাত্রায় নেমে যাওয়ায় সেখানেও উৎপাদন সঙ্কট দেখা দিয়েছে; ফলে দেশেজুড়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সঙ্কটে খাদ্য ও ওষুধের দামও হু হু করে বাড়ছে, ফুরিয়ে আসছে এসব পণ্যের মজুদ। চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, চিনি, দুধ কিনতে মানুষকে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। গত মাসে জ্বালানি তেল সংগ্রহের লাইনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করার সময় অন্তত দুজনের মৃত্যুর খবরও এসেছে।

শ্রীলঙ্কার পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে, মার্চে মূল্যস্ফীতি হয়েছে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ১৮.৭ শতাংশ। খাদপণ্যের মূল্যস্ফীতি ৩০.২ শতাংশে পৌঁছেছে।

এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে শ্রীলঙ্কার রুপির অবমূল্যায়ন। মার্চের শুরুতে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রুপির বিনিময় হার খোলাবাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ায় তা ৩০ শতাংশের বেশি বেড়ে প্রতি ডলারের বিপরীতে ২৭৫ রুপি দরে লেনদেন হয়।

তা ছাড়া বিদেশি মুদ্রা বাঁচাতে গত বছর কিছু দিন সার আমদানি বন্ধ রেখেছিল সরকার। তার খেসারতও এখন দিতে হচ্ছে পণ্যমূল্যে।

ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেলের মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় গত মাসে শ্রীলঙ্কা তাদের একমাত্র তেল শোধনাগারটি বন্ধ করে দেয়। ডিজেল সঙ্কট যত বাড়বে বিদ্যুতের লোডশেডিংও তত বাড়তে থাকবে।

বিদ্যুৎ না পাওয়ায় দেশটির প্রধান স্টক মার্কেটে লেনদেনের সময় কমিয়ে এনেও কাজ হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বাঁচাতে সড়ক বাতিও নিভিয়ে রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎমন্ত্রী পবিত্র ভান্নিয়ারাচ্চি।

অনেকেই অর্থনীতির অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারকে দোষারোপ করছেন।

কর প্রত্যাহারে কোষাগারে চাপ

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কর প্রায় অর্ধেক কমানোর। কিন্তু এই কর কমানোর ফলে সরকারি কোষাগারের বিলিয়ন রুপির রাজস্বের ক্ষতি হয়েছে। ফলে সরকারের অর্থায়নে ঘাটতি তৈরি হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কা।

পর্যটন খাত থেকে দেশটির মোট অর্থনীতির ১২ শতাংশ জোগান দেয়। কিন্তু কোভিড মহামারীর কারণে সেই খাতে ধস নেমেছে দুই বছর আগে।

বিবিসির তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে পর্যটন খাত থেকে দেশটির আয় ছিল ৪০০ কোটি ডলার। মহামারীর খাঁড়ায় পরের বছর তা ৯০ শতাংশ কমে যায়। মহামারী চলায় এখনও সুদিন ফেরেনি এই খাতে।

শ্রীলঙ্কার সরকারি ঋণ মহামারীর আগে থেকেই অসহনীয় পর্যায়ে ছিল। অনুমান করা হয়েছিল, এই ঋণ ২০১৯ সালের জিডিপির ৯৪ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে ১১৯ শতাংশ পর্যন্ত হবে।

কলম্বোর ফ্রন্টিয়ার রিসার্চ গ্রুপের অর্থনীতিবিদ চেয়্যু দামসিংহে বলেছেন, “কর হ্রাস ও পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নের ফলে অনিবার্য ওই সঙ্কট আরও শোচনীয় হয়েছে।”

অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা

রয়টার্স লিখেছে, এই সঙ্কটের মূলে রয়েছে শ্রীলঙ্কার সরকারগুলোর অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা। এর ফলে চলতি হিসাবের ঘাটতির পাশাপাশি বাজেট ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ২০১৯ সালের কার্যপত্রে বলা হয়েছে, “শ্রীলঙ্কা হলো যমজ ঘাটতির দেশ। এই জোড়া ঘাটতি ইঙ্গিত দেয়, একটি দেশের জাতীয় ব্যয় তার জাতীয় আয়কে ছাড়িয়ে গেছে এবং ব্যবসায়িক পণ্য ও সেবার উৎপাদন অপর্যাপ্ত।”

কিন্তু বর্তমান এই সঙ্কট বেড়েছে ২০১৯ সালে রাজাপাকসার কর প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতির কারণে। ওই প্রতিশ্রুতির পরই দেশে কোভিড হানা দেয়। ফলে আরও ধস নামে।

পর্যটন শিল্পের সঙ্গে বিদেশি কর্মীদের পাঠানো রেমিটেন্স হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো শ্রীলঙ্কাকে নিচে নামিয়ে দেয় এবং আন্তর্জাতিক পুজিবাজারে দেশটির লেনদেন আটকে দেয়।

পরিবর্তে শ্রীলঙ্কার ঋণ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি থেমে যায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দুই বছরে প্রায় ৭০ শতাংশ হ্রাস পায়।

২০২১ সালে সমস্ত রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে রাজাপাকসের সরকার। পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত উল্টে গেলেও দেশের কৃষি খাতেও চপেটাঘাত করে এবং ধানের উৎপাদনে ধস নামে।

এর পাশাপাশি শ্রীলঙ্কার রাজনীতিক আর আমলাদের বিশাল অপব্যয়ের কথাও লিখেছেন দেশটির বাণিজ্য বিষয়ক প্রভাবশালী সংবাদপত্র ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক কলামনিস্ট ভিক্টর ইভান।

তিনি লিখেছেন, শ্রীলঙ্কায় রাজনীতিক পোষার খরচ উন্নত অনেক দেশের চেয়ে বেশি, যা দেশের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।তাদের ও আমলাদের গাড়ি-বাড়িসহ অন্যান্য খাতে যে রাষ্ট্রীয় ব্যয় হচ্ছে, তা কমিয়ে ফেললেও অনেক অর্থ বাঁচে।

জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ক্ষোভ থামাতে এর মধ্যে কিছু দিন আগেই সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও পেনশনের অর্থ বাড়ায় সরকার, যা চাপ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

বৈদেশিক ঋণ

রয়টার্স লিখেছে, ফেব্রুয়ারির হিসাবে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। কিন্তু ২০২২ সালে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারের আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডের (আইএসবি) ঋণ জুলাইয়ে পরিশোধ করতে হবে।

গত মাসে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির পর্যালোচনায় আইএমএফ বলেছে, দেশটির সরকারি ঋণ ‘অস্থিতিশীল পর্যায়ে’ বেড়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিকট-মেয়াদী ঋণ পরিশোধের জন্য অপর্যাপ্ত।

গত মাসের শেষের দিকে সিটি রিসার্চ বলেছে, আইএমএফের রিপোর্টের শেষে যা বলা হয়েছে এবং সরকারের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ঋণের স্থায়িত্ব পুনরুদ্ধার করার জন্য অপর্যাপ্ত ছিল, যা ‘ঋণ পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তাকে’ দৃঢ়ভাবে নির্দেশ করে।

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3