বিদেশ থেকে শিক্ষক হায়ার!

ড. নজরুল ইসলাম

উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসার খবর বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কাদেরকে নিয়ে আসবেন, কিভাবে নিয়ে আসবেন, তাঁদের মর্যাদা, বেতন, ভাতা ও সম্মানী কাঠামো কিরূপ হবে, তাঁরা কি সরকারি বেতন স্কেলে এইসব পাবেন নাকি ভিন্ন কাঠামোয় তার ব্যবস্থা হবে, সরকারি বেতন কাঠামোয় এসব দিলে তাঁরা আদৌ আসবেন কিনা, তাঁদের সাথে দেশীয় শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদা একই মানদণ্ডের আলোকে হবে কিনা–এইসব প্রশ্নের নিশ্চয়ই অবতারণা হবে। তবে তার আগে যেটি অনুধাবনীয় সেটি হল, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ এটা স্বীকার করে নিয়েছে যে, বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ঠিকমত চলছে না। আমার মনে হয় এটা একটা প্রাথমিক অগ্রগতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের চিন্তাশীল শিক্ষকসহ অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে এসব বিষয় নিয়ে বলে আসছেন। এখন একটা কিছু করার সময়।

যে কোন দেশের শিক্ষা বিভাগের গুরুত্ব সর্বাগ্রে। সব কিছুর কেন্দ্রে শিক্ষা। এটা একটা জাতির পাওয়ার হাউজ। এ জায়গাটায় গণ্ডগোল থাকলে গোটা জাতির মধ্যে, সমাজের মধ্যে, রাষ্ট্রের মধ্যে গণ্ডগোল থাকবে। এ জায়গাটা ঠিক না করে অন্য কোনটাই ঠিক করা যাবে না। চাইলেও পারা যাবে না। এখন কথা হল, আমাদের সমস্যাটা কি গোটা সিস্টেমে, না-কি সিস্টেমের একটা পার্ট মানে শিক্ষকদের নিয়ে? সবাই স্বীকার করবেন যে, গোটা সিস্টেমেই সমস্যা। সেই হেতু শিক্ষকরাও এ থেকে মুক্ত না। কাজেই কিছু একটা করতে হলে গোটা সিস্টেমকে ঠিক করতে হবে। দু’চার, পাঁচ, দশ, পঞ্চাশজন শিক্ষক বিদেশ থেকে এনে খুব একটা কিছু হবে বলে মনে হয় না। প্লিজ। ধরে নিবেন না যে, আমি এর বিপক্ষে। আমি একশত ভাগ বিদেশী মানে আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টি আকৃষ্ট করার পক্ষে। কেবল আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টি না, আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীও আকৃষ্ট করতে হবে। এটা কেমনে করবেন? এর জন্য গ্রান্ড প্লান নেয়া দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় কোন গার্মেন্টস শিল্প না যে, পাঁচ, দশ, বিশজন এক্সিকিউটিভ বিদেশ থেকে এনে চালিয়ে নিবেন। গোটা সিস্টেমের মেরামত দরকার। সিস্টেম যদি ঠিক হয়ে যায়, এ দেশীয় শিক্ষকরাও আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টিতে উন্নীত হবেন (অনেক শিক্ষক আছেন যাঁদের জ্ঞান, গবেষণা, ইন্টেলেকচুয়াল ক্যাপাসিটি বিশ্বমানের)। আমি কেবল সিস্টেমের একটা অংশকে ফোকাস করার চেয়ে গোটা সিস্টেমকে ফোকাস করার পক্ষে।

এ অবস্থায় আমাদের কি করা উচিৎ? এক্ষেত্রে প্রথমেই একটা উচ্চ শিক্ষা কমিশন করা দরকার। আর এটা করার জন্য আগে বাজেটে বরাদ্দ কেবল সর্বোচ্চ দিলেই হবে না, বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী জিডিপির শতকরা ৪/৫ ভাগ বরাদ্দ দিতে হবে। এখানে অন্য কিছুর সাথে তুলনা করা চলবে না। এরপর এই কমিশনে স্বীকৃত গবেষক, অধ্যাপকদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে। রাজনৈতিক দলের লেজুরভিত্তিক শিক্ষকদের সম্মানের সাথে এর বাইরে রাখা বাঞ্চনীয়। কারণ, তাঁরা চাইলেও তাঁদের কানেকশনের কারণে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। মনে রাখা দরকার, আর যাই হোক, শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি চলে না। বাইরের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপকদের, এমনকি বাংলাদেশী অধ্যাপক, গবেষক যারা আছেন, তাঁদেরকেও এর সাথে সংশ্লিষ্ট করা যেতে পারে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এমন একটি মহতি উদ্যোগের সাথে তাঁরা দরকার হলে বিনা পয়সায় কন্সাল্টেন্সি বা কন্ট্রিবিউট করতে এগিয়ে আসবেন। এই কমিশন চুলচেরা বিশ্লেষণ করে যে রিপোর্ট দিবে তার আলোকে বিদেশী শিক্ষক আনেন, ছাত্র আনেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনীতি বিদায় করেন, সব ঠিক করতে হবে। ইউজিসি এইটা করতে পারত। কিন্তু বর্তমান ইউজিসি’র সেই ক্ষমতা, সক্ষমতা কিংবা সামর্থ কোনটাই নাই। এই দেশের একটা বড় সমস্যা হল, কি সরকারি, কি আধা-সরকারী, কি স্বায়ত্বশাসিত, সব প্রতিষ্ঠানই যেন সরকারের এক একটা এক্সটেন্ডেড অর্গান/কমিটি। সরকারি টাকায় চললেই সব জায়গায় সরকারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে-এটা অদ্ভুত ব্যাপার। তাই যদি হয়, তাহলে স্বায়ত্বশাসনের অর্থটা কি দাড়ায়?

বিশ্ববিদ্যালয় কোন আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান না। অবাধে যে কোন বিষয়ে গবেষণা করা এবং যে কোন চিন্তা, মত ও তথ্যপ্রবাহের অবাধে চলাচল করার, প্রচার করার, ডেলিভারি দেয়ার ক্ষেত্র যদি বিশ্ববিদ্যালয় না হয়, সেইটা বিশ্ববিদ্যালয় হবে কিভাবে? আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে এসব চলে না। চিন্তা, মত কোন সুনির্দিস্ট ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়ে চলে না। বিশ্ববিদ্যালয় এমনই। আর এইটা একটা বড় কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে ঐক্য না হওয়ার। সিভিল, মিলিটারী ব্যুরোক্রেসির মত পেশাগত ঐক্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কোন কালে হবে না। হওয়া উচিৎও না। প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কিংবা আনু মুহাম্মদের চিন্তার সাথে প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ কিংবা এ কে আজাদ চৌধুরীর চিন্তার মিল কিভাবে হবে? এই হওয়াটা কি জরুরী? আমি তা মনে করি না। যেটা হওয়া দরকার, সত্যকে সত্য বলা, মিথ্যাকে মিথ্যা বলা, যাকে ইংরেজীতে বলে, টু কল এ স্পেড এ স্পেড। সাহসের সাথে সত্য উচ্চারণ, ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা, তাতে স্বীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও। প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, এমাজউদ্দিন আহমদ, আনু মুহাম্মদ কিংবা প্রফেসর এ কে আজাদ চৌধুরী তাঁদের নিজ নিজ আদর্শ ও অবস্থানে থেকেও এটা করতে পারেন। এই জায়গাটায় আমাদের আসা দরকার।

যে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অশ্রুতিমধুর অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর হতে এমনকি ছাত্রসম পাতি  নেতা, রাজনীতিকদের দরজায় ঘোরতে হয়, ঘন্টার পর ঘন্টা এসব নেতাদের ড্রয়িং রুমের সোফায় অপেক্ষা করতে হয়, সরকারি দলের শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের সন্তুষ্টির উপরে একজন ভাইস-চ্যান্সেলরের পদ টিকে থাকে, যে দেশে গবেষণা কিংবা ইন্টেলেকচুয়াল কন্ট্রিবিউশনের চেয়ে বরং পপুলিজমের খপ্পরে পড়ে শিক্ষক রাজনীতির মাধ্যমে শিক্ষা প্রশাসনের বড় বড় পদ ভাগিয়ে নেয়া যায় বা নেয়ার ব্যবস্থা থাকে, সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিদেশ থেকে জনাকতক গবেষক, অধ্যাপক এনে শিক্ষার খুব একটা উন্নয়ন হবে, আমার তা মনে হয় না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, কোন “চেরি পিক” পলিসি না নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক পলিসি নেয়া দরকার। এই পলিসির আউটকাম হিসেবে শিক্ষকরা রাজনীতি করবে না, ছাত্ররা প্রচলিত তথাকথিত ছাত্ররাজনীতি করবে না, শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, সম্মান, মর্যাদার একমাত্র মানদণ্ড হবে রিসার্চ এন্ড ইন্টেলেকচুয়াল কন্ট্রিবিউশন, ক্যাম্পাসে থাকবে দেশীয় শিক্ষক, ছাত্রের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টি, স্টুডেন্টদের বিচরণ, শিক্ষকদের ল্যাব, অফিসগুলি গভীর রাত পর্যন্ত আলোকিত থাকবে নতুন নতুন জ্ঞান উৎপাদনের লক্ষে, শিক্ষকরা শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সেক্রেটারী কিংবা হল প্রোভোস্ট বা প্রোক্টর হওয়ার চেয়ে গবেষণা আর্টিকেল ছাপানোটাকে অধিকতর সম্মানের কাজ মনে করবে এবং এ লক্ষে প্রতিযোগিতা করবে, রাজনৈতিক নেতাদের দরজায় না গিয়ে বরং নেতারা শিক্ষকদের দরজায় ঘোরাঘুরি করবে, জাতির সুখে, দুঃখে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করবে, মানুষ অধির আগ্রহে অপেক্ষা করবে নেতৃস্থানীয় শিক্ষক, গবেষকরা কি বলেন তা শোনার জন্য, সকাল/বিকাল কেবল নীল/সাদা খামের জন্য টেলিভিশনে না গিয়ে দেশের জন্য টেলিভিশনগুলিতে যাবেন, সাহসের সাথে সত্য উচ্চারণ করবেন যে কোন কারও রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। এই জন্য একটা উচ্চ শিক্ষা কমিশন করে গোটা সিস্টেমকে ঢেলে সাজাতে হবে।

লেখক: ড. নজরুল ইসলাম, প্রফেসর, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

  •  
  •  
  •  
  •