পোল্ট্রি শিল্পের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত
ড. মো: আজাদুল হক
অতীতে, এক সময় মানুষ বনে-জঙ্গলে লতা পাতা, পশু-পাখি খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করত। আস্তে আস্তে সভ্যতার বিবর্তনে মানুষ রান্না করে খাওয়া শিখল। পরবর্তীতে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের অন্বেষণ শুরু করতে লাগল। শুরু হল পুষ্টির চাহিদা মেটাতে বিজ্ঞানের যুগের পদার্পন। বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে মানুষ সহজে পুষ্টি চাহিদা পূরণ করার কৌশল আবিষ্কার করা শুরু করল। যার ধারাবাহিকতায় গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি ইত্যাদির উন্নত জাত আবিষ্কার করতে লাগল। এক সময় মানুষ এসব পোল্ট্রি তথা হাঁস, মুরগি (ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালি), গরু, ছাগল বসতবাড়িতে লালন-পালন করত।
১৯২৩ সালে আমেরিকায় সর্ব প্রথম পোল্ট্রি ধারণাটির সূত্রপাত হয়। বাংলাদেশে ধারণাটির উদ্ভব হয় ১৯৬০ সালে। ১৯৬৮ সাল হতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পোল্ট্রি বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে। দেশে বাণিজ্যিকভাবে ব্রয়লার, লেয়ার শিল্পের যাত্রা শুরু হয় ৮০ এর দশকে। যা পরবর্তীতে ৯০ এর দশকে গতিশীলতা লাভ করে। বিশ্বের অনেক দেশ যেমন: ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এখন পোল্ট্রি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে সুপরিচিত।
বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। মানসম্মত পুষ্টি চাহিদা পূরণে আমাদের প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে। মানুষের খাদ্যের মূল উপাদন সমূহের মধ্যে আমিষ অন্যতম। তার মধ্যে প্রাণিজ আমিষ বিশেষ ভূমিকার দাবিদার এবং এই প্রাণিজ আমিষের প্রধানতম উৎস পোল্ট্রি ডিম ও মাংস যা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী। বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও সরকারের বিভিন্ন উদ্যেগে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
লাগসই উন্নয়ন অর্জনের স্বার্থে সরকার এবং জাতিসংঘ বেশ কিছু লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-ক্ষুধা, দারিদ্র ও বেকারত্ব নিরসন, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি। বলাবাহুল্য এ লক্ষ্য অর্জনে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান বড় ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের লক্ষ্যে ঘোষিত জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) এর ১৭ টি লক্ষ্যের মধ্যে ‘লক্ষ-২’ সরাসরি এবং সর্বমোট প্রায় ১৪টি লক্ষ্যের সাথে কোন না কোনভাবে পোল্ট্রি সেক্টরের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পোল্ট্রিখাত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলছে। বর্তমানে জিডিপি’তে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান ২ শতাংশের ওপরে। এখাতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও অধিক বিনিয়োগ হয়েছে। বার্ষিক টার্নওভার ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩০ লাখ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। পোল্ট্রি’র মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে শিক্ষিত ও বেকার যুবক এবং নারীদের কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার কারণে গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের স্রোত কিছুটা হলেও কমেছে। যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং আবাদি জমি কমেছে তাতে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে, প্রয়োজন হবে ভার্টিক্যাল ইন্ট্রিগ্রেশন-যা পোল্ট্রি’তে সম্ভব।
বিগত বছরগুলোতে পুষ্টি ঘাটতি পূরণে পোল্ট্রি’র চাহিদা এবং এর ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বেড়েছে। হাউজহোল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের রিপোর্ট অনুযায়ী পূর্বের বছরের তুলনায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশে দৈনিক মাথাপিছু ফুড কনজাম্পশন কমলেও বেড়েছে মুরগির মাংস ও ডিমের কনজাম্পশন। পূর্বে যেখানে দৈনিক মাথাপিছু ফুড কনজাম্পশন ছিল ১০০৫ গ্রাম, ২০১৬ সালে তা কমে হয়েছে ৯৭৪ গ্রাম। অন্যদিকে মুরগির মাথাপিছু কনজাম্পশন ১১.২২ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ১৭.৩৩ গ্রাম। ডিমের কনজাম্পশন ৭.২ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৫৮ গ্রাম। প্রানিজ আমিষের অপরাপর উৎসগুলোর চেয়েও পোল্ট্রির কনজাম্পশনে প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মত। যেখানে গরুর গোশতের কনজাম্পশন ১০% এবং মাছের ২৬% বেড়েছে, সেখানে পোল্ট্রির মাংস ও ডিমের কনজাম্পশন বেড়েছে যথাক্রমে ৫৪% এবং ৮৮%। আগামীতে সন্দেহাতীতভাবেই এ পরিমান আরও বাড়বে।
এহেন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে প্রমোটারের ও মুরগিতে এন্টিবায়োটিক (এজিপি) এর ব্যবহারের ভীতি, ডিম মুরগির দামের পতনে নাস্তা নাবুত; তদুপরি বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীনও হতে হচ্ছে। মানসম্পন্ন ডিম ও মাংস উৎপাদন এখন কতটা সম্ভব? আমাদের জানতে হবে উৎপাদনের পাশাপাশি এ সকল খাদ্য কতটা নিরাপদ? আর নিরাপদ না হলে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মানুষ এক সময় বাড়ির আঙ্গিনায় হাঁস-মুরগি লালন-পালন ও উৎপাদন করত। পরে যখন বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করতে লাগল তখন অসুস্থ প্রতিযোগীতার কারণে কত কম সময়ে উৎপাদন করা যায় সেদিকে মনোযোগী হল।
শুরু হল পোল্ট্রি ফিডে গ্রোথ প্রমোটারের ও মুরগিতে এন্টিবায়োটিক (এজিপি) এর ব্যবহার। এখন আমাদের জানতে হবে বাজারে কোন ডিম ও মুরগিতে এন্টিবায়োটিক, পোল্ট্রি ফিডে গ্রোথ প্রমোটারের সাধারণত মুরগির অসুখ হলে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে এবং মুরগির খাদ্য উৎপাদন এর সময় গ্রোথ প্রমোটার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সাধারণত খামারি মুরগির অসুখ হলে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করে।
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পোল্ট্রি ফিডে গ্রোথ প্রমোটার ব্যবহার করে থাকে। আমাদের জানতে হবে কারা বা কে? আমাদের দেশে মাসে প্রায় ৪৫০ টি ফিড মিল মিলে সাড়ে চার লাখের বেশী ফিড উৎপাদন করে থাকে। যার ৭০ ভাগ করে দেশী বিদেশী ১০ টি উন্নত মানের কোম্পানি,২৫ ভাগ করে মধ্যম সারির কোম্পানি এবং ৫ ভাগ ছোট ফিড মিল। বড় ফিড মিলগুলো গুনগত ফিড উৎপাদন করছে, জানা মতে তারা গ্রোথ প্রমোটার ব্যবহার করে না বললেই চলে, করলেও দুই একটি কোম্পানি। মধ্যম সারির কোম্পানি গুলোর মধ্যে দুই একটি গ্রোথ প্রমোটার ব্যবহার করলেও আশার কথা যে, বর্তমানে গ্রোথ প্রমোটর আমদানী নিষিদ্ধ করাই তা এখন ব্যবহার হয় না বললেই চলে।
ক্ষতিকারক উপকরণ ও এন্টিবায়োটিক মুক্ত পোল্ট্রি ফিড, ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্প ইতোমধ্যেই বেশ খানিকটা সফলতা অর্জন করেছে। দেশে এখন নিরাপদ ফিড উৎপাদিত হচ্ছে-কারণ বিগত কয়েক বছর ধরে সরকার পোল্ট্রি ফিডে এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রমোটারের (এজিপি) ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও ভ্রাম্যমান আদালতের সহযোগিতায় অবৈধ এবং নিম্নমানের পোল্ট্রি ও ফিস ফিড উৎপাদনকারি বেশকিছু কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। সরকারের নজরদারী সংশ্লিষ্ট অ্যাসোসিয়েশনগুলোর কার্যকরী উদ্যোগ, ভোক্তা সাধারণের সচেতনতা এবং মান সম্মত হেভি মেটালের সমস্যা প্রায় শুণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এখন আমাদের জানতে হবে পোল্ট্রিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল কি কি?
নিরাপদ পোল্ট্রি ফিডে ব্যবহৃত কাঁচামালের (ফিড ইনগ্রিডিয়েন্টস)মধ্যে উল্লেখ যে, প্রধানত ভূট্টা এবং সয়াবিন মিলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করছি এ কারণে যে পোল্ট্রি ফিডের প্রায় ৫৫-৬০ ভাগই হচ্ছে ভূট্টা এবং ২০-২৫ শতাংশ সয়াবিন মিল। ফিড এডিটিভস যেমন- ভেজিটেবল প্রোটিন হিসেবে ব্যবহৃত DDGS,Limestone, Lysine, Fish Oil, Di-calcium Phosphate, L-Threonine, L-Methionine, Ful Fat Soya, Mono-Calcium Phosphate, Choline Chloride, Enzyme, Sodium Bi-Carbonate, Soya Protein Concentrate প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে নিরাপদ পোল্ট্রি পণ্য (ডিম, মুরগি) সাশ্রয়ী মূল্যে (ক্রমক্ষমতার মধ্যে) উৎপাদন করে ভেক্তদের আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে জাতীয় লক্ষ্য, এসডিজি অর্জনএবং রপ্তানীমূখী শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে এমনটাই প্রত্যাশা ।
লেখকঃ
ড. মো: আজাদুল হক, কৃষি অর্থনীতিবিদ
azadulbau@yahoo.com