করোনায় ভেটেরিনারিয়ানদের অবদান ও প্রত্যাশা

Shahiduzzaman

ড. মোঃ সহিদুজ্জামান

আজ ২৪ এপ্রিল, ২০২১ বিশ্ব ভেটেরিনারি দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত সচারচর বাংলাদেশেও অত্যান্ত গুরুত্বসহকারে দিবসটি পালন করা হয়। তবে করোনা মহামারির কারণে গত বছরের ন্যায় এ বছরও সীমিত পরিসরে পালিত হবে এ দিবসটি। এবারের প্রতিপাদ্য “Veterinarian response to the Covid-19 crisis”। বাংলায় অনেকটা বলা যায় ”কোভিড-১৯ সংকটে ভেটেরিনারিয়ানদের সাড়া”। প্রতি বছর এপ্রিল মাসের শেষ শনিবার এই দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে। এ দিবসটিকে প্রাণির স্বাস্থ্য, মানুষ এবং পরিবেশের উপর ভেটেরিনারিয়ানদের অবদান উদযাপন করার একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

প্রলম্বিত কোভিড-১৯ মহামারী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির জীবনকে বদলে দিচ্ছে। উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করছে বিশ্বব্যাপী মানুষ ও অন্যান্য প্রাণির জীবনযাত্রাকে। তবুও এই চ্যালেঞ্জিং সময়ের মধ্য দিয়ে ভেটেরিনারিয়ানরা পরিস্থিতির সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে তাদের সেবা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রযুক্তির সমন্বয়ে তারা প্রাণির স্বাস্থ্য ও কল্যাণ এবং নিরাপদ প্রোটিন সরবরাহের মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যে তাদের ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কাজ করে যাচ্ছে।

বৈশ্বিক মহামারিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা সনাক্তকরণে টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে যাচ্ছে ভেটেরিনারিয়ানরা। শুধু তাই নয়, মানুষে করোনা টিকা প্রদানের জন্য ভেটেরিনারিয়ানদের সহযোগিতা নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। অনস্পট ট্রেনিং নিয়ে তারা সেবা দিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষদের। করোনা টিকার উৎপাদন এবং এনিমেল মডেলে এর কার্যকারিতা পরীক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে এই ভেটেরিনারিয়নরা। বসে নেই বাংলাদেশের ভেটেরিনারিয়রাও। দেশের করোনা টেস্ট ল্যাবের তদারকি, আরটিপিসিআর এ টেকনিক্যাল সাপোর্ট, রিপোর্ট তৈরিতে সহযোগিতা করছে দেশের ভেটেরিনারিয়ানরা। ড. বিজন কুমার শীল কর্তৃক র‌্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিএউচও) সম্পৃক্তায় সরকারের আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) এর করোনা এক্সপার্ট পুলো কাজ করা, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা টেস্ট ল্যাব স্থাপন এবং বিভিন্ন সরকারী ও বেসসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অনেক ভেটেরিনারিয়ান করোনা মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছেন। এছাড়া আমাদের ভেটেরিনারিয়ানরা করোনার জেনম সিকোয়েন্সিং ও ভ্যারিয়েন্ট সনাক্তকরণে কাজ করে যাচ্ছে। খোলা বাজারে ডিম, দুধ, মাংস ন্যায্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা করছেন। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে অনেক ভেটেরিনারিয়ান কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি দেশের প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি ও অর্থনীতিতেতে অবদান রাখছে। বলা যায়, কোভিড-১৯ মহামারি ‘এক স্বাস্থ্য‘ ইস্যুতে ভেটেরিনারিয়ানদের নেতৃত্বের একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। খাদ্য সুরক্ষা, নিরাপদ পুষ্টি, খাদ্য সংরক্ষণ, বর্তমান মহামারী নিয়ন্ত্রণ এবং ভবিষ্যতে মহামারী প্রতিরোধে ভেটেরিনারিয়ানরা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও বন্য প্রাণির পরিবেশে অযাচিত হস্তক্ষেপ, অবৈজ্ঞানিকভাবে গৃহে পশুপালন ও বিকৃত খাদ্যাভাস মানুয়ের স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ নতুন এই করোনাভাইরাসসহ সার্স, মার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি। এছাড়া মশা, মাছি সহ বিভিন্ন কীট পতঙ্গ দ্বারা মানুষে সংক্রমিত ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, চিকুনগুনিয়া, জিকা, জলাতংক এবং ডায়রিয়া সহ অনেক রোগের উৎপত্তি পশুপাখি থেকে। বিশ্বে এ পর্যন্ত যত ধরণের মহামারী হয়েছে তার প্রায় সবই প্রাণি থেকে উৎপত্তি। নভেল করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর ব্যাতিক্রম নয়। তাই এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে ’এক স্বাস্থ্য’ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নাই। এক স্বাস্থ্য ইস্যুতে হিউম্যান ডাক্তারদের পাশাপাশি ভেটেরিনারিয়ানদের যুগপৎ অংশগ্রহণ ও অবদান বাড়াতে আরও উদ্যোগি হতে হবে। পেশায় বৈচিত্র আনতে ভেটেরিনারিয়ানদের আত্মনিয়োগের প্রচেষ্টা এবং সমাজে অবদানের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

যদিও পশুপাখি থেকে কভিড-১৯ সংক্রমণের কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখনো মেলেনি, তবে মানুষ থেকে দু-চারটি প্রাণিতে সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। গবাদি পশুপাখির সঙ্গে মেলামেশা, সেবা ও ব্যবস্থাপনা এবং ভক্ষণের ক্ষেত্রে সংক্রমণের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে মেডিক্যাল ও ভেটেরিনারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংক্রমিত রোগ সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে। বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, চিত্র প্রদর্শনী, কার্টুন ও লিফলেটের মাধ্যমে সহজ ও সাবলীলভাবে তারা এসব রোগের জীবনচক্র, ক্ষতিকারক দিক এবং সংক্রমণ ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিয়ে থাকে।

শুধু করোনাভাইরাস নয়, মানবদেহের রোগবালাইয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ আসে পশুপাখি ও জলজ প্রাণি থেকে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মাংস প্রক্রিয়াকরণ ও বিক্রি, ক্রেতাদের সতেজ বা তাজা মাংসের প্রতি আগ্রহ, প্রাণির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বা সংস্পর্শ নতুন নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই এসব প্রাণি সংরক্ষণ, উৎপাদন ও ভক্ষণের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভেটেরিনারিয়ানদের ভূমিকা জোড়দার করতে হবে। যেখানে-সেখানে খোলাভাবে গবাদি পশুপাখি জবাই ও বিক্রির সংস্কৃতি বন্ধ করতে কাজ করতে হবে। নতুন নতুন জুনোটিক ডিজিজের সন্ধানে কাজ করতে হবে।

যৌথ গবেষণা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে করোনাসহ যে কোন মহামারীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজ করতে হবে। করোনা প্রতিনিয়ত মিউটেশনের ফলে নতুন নতুন স্ট্রেইন বা ভ্যারিয়েন্ট তৈরি করছে এর বিপরীতে কার্যকর প্রতিষেধক বা টিকা তৈরিতে দেশেই গবেষণার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। সরকারের পৃষ্টপোষকতা পেলে আমাদের ভেটেরিনারিয়ানগণ দেশীয় গবেষণার মাধ্যমে করোনার ভ্যারিয়েন্ট সনাক্তকরণ, জেনোম সিকোয়েন্সিংও টিকা উৎপাদনের মাধ্যমে করোনা মহামারী প্রতিরোধে আরো গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে পারবে।

বিশ্বে ভেটেরিনারি চিকিৎসা, রোগনির্ণয় ও রোগ সার্ভিল্যান্স ব্যবস্থার ব্যাপক অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশের অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। গবাদি পশুপাখির রোগ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় প্রাণির অত্যাধুনিক রোগ নির্ণয় ল্যাব, বর্ডার এলাকায় যুগোপযুগী কোয়ারেন্টাইন স্টেশন, কেন্দ্রীয় রোগতত্ত্ব ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্র বা এপিডেমিওলজি ইউনিট, জুনোটিক ডিজিজ গবেষণা কেন্দ্র, ট্রপিক্যাল বা সাবট্রপিক্যাল ভেটেরিনারি মেডিসিন প্রতিষ্ঠান, ভেটেরিনারি অর্থনীতি ও বিপনন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও কার্যকরকরণ সাপেক্ষে ভেটেরিনারিয়ানদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে প্রাণিসম্পদের অবদান ত্বরান্বিত হবে।

ভেটেরিনারি সেবাকে জরুরি সেবা হিসেবে ঘোষণা করা, হিউম্যান ডাক্তারদের ন্যায় ভেটেরিনারিয়ারদের সরকারী চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করা, আরভি এন্ড এফসি (রিমাউন্ড ভেটেরিনারি এন্ড ফার্ম কোর), আর্মি মেডিকেল, আর্মি ডেন্টাল কোর, ও ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের মত ন্যায় সরাসরি ক্যাপটেন পদে নিয়োগ প্রদান, অর্গানোগ্রামের ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন, ভেটেরিনারি শিক্ষায় যুগোপযুগী কারিকুলা ও পাঠদান, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাইভেট জবে ভেটেরিনারিয়ানদের পদে ডিপ্লোমা ভেটদের নিয়োগ বন্ধ করা, মাঠ পর্যায়ে প্রাণিচিকিৎসায় কোয়াকদের দোরাত্ম হ্রাস করা, পশুচিকিৎসক শব্দটির পরিবর্তে ভেটেরিনারি ডাক্তার বা ভেটেরিনারিয়ান শব্দের বহুল প্রচার ও বাস্তবায়ন, এক বিশ্ব,এক স্বাস্থ্য (ওয়ান ওয়াল্ড, ওয়ান হেলথ) বাস্তবায়নে ডাক্তারদের সাথে ভেটেরিনারিয়ানদের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার দাবী সকল ভেটেরিনারিয়ানদের।

বহির্বিশ্বের মত দেশের ভেটেরিনারিয়ানদের করোনা টিকা প্রদান কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার সুযোগ রয়েছে সরকারের।

মানুষ ও প্রাণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, চিকিৎসায় ও রোগ প্রতিরোধে মেডিক্যাল ডাক্তারদের সাথে ভেটেরিনারিয়ানদের সমন্বিতভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরী। উন্নত বিশ্বে এমন সমন্বয় থাকলেও আমাদের দেশে এখনো তেমন সমন্বয়তা গড়ে ওঠেনি। তবে আশার কথা, ধীরে ধীরে এই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।

লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোঃ সহিদুজ্জামান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

  •  
  •  
  •  
  •  
ad0.3