কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধি: ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা চরম ঝুঁকিতে

ড. মোঃ ওয়াকিলুর রহমান
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, নারী ও বর্গা চাষির সংখ্যা প্রায় ৮৪.৩৫ শতাংশ। এসকল কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য সংগ্রহের পরক্ষণে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এর অন্যতম কারণ হলো তাদের পণ্য উৎপাদনে যে উপকরণ খরচ হয় তা ধার-দেনা করে নির্বাহ করতে হয়। ধার-দেনা মিটিয়ে যা অবশিষ্ট অর্থ থাকে তা দিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ ও পরবর্তী ফসল উৎপাদনের জন্য ব্যয় করে থাকেন। এধারা বছর বছর অব্যহত থাকে। তাদের এই দৈন্যদশা দিন দিন বাড়ে বৈকি কমেনা। তাদের এই নিম্নগামী অবস্থা আরো দুর্বিষহ হয় যখন উপকরণের দাম বেড়ে যায়। কৃষি উৎপাদনের অন্যতম উপকরণ হলো- বীজ, সার, সেচ, মজুরি, কীটনাশক প্রভৃতি। বলা বাহুল্য, অধিকাংশ কৃষক এখন বীজ নিজ সংগ্রহে রাখেন না বরং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে চড়া দামে কিনে থাকেন।
অন্যদিকে, কৃষকেরা ফসলভেদে সারের জন্য প্রায় ১৩-২০ শতাংশ ব্যয় করে থাকেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আর্থিক দৈন্যতার কারণে প্রান্তিক, নারী ও বর্গা চাষিরা তুলনামূলকভাবে (পরিমিত মাত্রা অপেক্ষা) কম পরিমাণে সার ব্যবহার করেন এবং অনেক ক্ষেত্রে দোকান থেকে অধিকদামে বাকিতে সার ক্রয় করেন। নতুন করে ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধিতে (কেজি প্রতি ৬ টাকা) তাদেরকে অতিরিক্ত ৩৭.৫ শতাংশ ব্যয় বাড়াতে হবে যা সার্বিক উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যহত করবে। ইউরিয়া সারে ভর্তুকির ফলে উপকরণ ও উৎপাদন খরচ দুটিই কমে যায় ফলে উপকারভোগ করেন সর্বস্তরের জনগণ। অন্যদিকে, বর্ধিত দামের কারণে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হন।
গত ১৫ বছর সারের চাহিদা ও যোগান পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ইউরিয়া সারের চাহিদা ছিল ২৮.১৪ লক্ষ মে. টন এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ছিল ১৪.০০ লক্ষ মে. টন। বাকি সার আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। গত ৬ বছর যাবৎ ইউরিয়া সারের চাহিদা কিছুটা কমে ২৪-২৬ লক্ষ মে. টনস্থিতিশীল ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নিজস্ব উৎপাদন সক্ষমতা না বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। গত ৬ বছর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ১০.০০ লক্ষ মে. টন সীমাবদ্ধ রেখে আমদানিকে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, অধিক বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করতে হচ্ছে এবং ভর্তুকির পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলছে। বিদেশি নির্ভরতার নীতি-কৌশলের দায় কেন গরিব কৃষকের ঘাড়ে চাপানো হলো তা বোধগম্য নয়।
কৃষকেরা যখন ইউরিয়া সারের অতিরিক্ত দাম সমন্বয় করতে হিমশিম খাচ্ছে ঠিক তখনই ডিজেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি (৪২.৫%) “মরার উপর খরার ঘা” হয়ে দাড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম স্থীতিশীল বা কমতে শুরু করেছে তখনই তেলের দাম বৃদ্ধি মানুষের মনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি সেচ খরচ অনেকগুণ বাড়িয়ে দিবে। বাংলাদেশে মোট সেচ যন্ত্রের প্রায় ৭৮.৪৫ শতাংশ (ডিজেল চালিত ১২,৪৩,৭৭৯ টি এবং বিদ্যুৎ চালিত ৩,৪১,৬৩৪ টি) ডিজেল চালিত। এবং এসব সেচ যন্ত্রের মালিক তুলনামূলকভাবে কম সচ্ছল । যারা একটু স্বচ্ছল তারা বিদ্যুৎ চালিত সেচ যন্ত্র ব্যবহার করেন। তবে তাদেরও নিস্তার নেই, ক্রমাগত লোডশিডিং তাদেরকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশে সবচয়ে সফল যান্ত্রিকীকরণের উদাহরণ হলো পাওয়ার টিলার ও ট্রাক্টর এর ব্যপক ব্যবহার যা ডিজেলচালিত। কাজেই, ডিজেলের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি জমিচাষের খরচও বাড়িয়ে দিবে বহুগুন। শুধু জমিচাষ নয়, শস্য রোপন, কাটা ও মাড়াই যন্ত্রের চাহিদা ও ব্যবহারের যে গতি পেয়েছিল তাও স্থবির হয়ে যেতে পারে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ব্যহত হলে কৃষি শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যাবে এবং শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধি পাবে যা উৎপাদন প্রক্রিয়াকে ব্যহত করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিত্যনতুন রোগবালাই ও পোকার আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ফসলে কীটনাশক ও বালাইনাশকের ব্যবহার অনেকগুণ বেড়ে গেছে যা উৎপাদন ব্যয় ও পরিবেশ উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। এসকল দুর্যোগ মোকাবেলা করে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, নারী ও বর্গা চাষিদের উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত থাকা দুরূহ হয়ে পড়বে। এই বিশাল সংখ্যক কৃষককে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সাথে ধরে রাখতে না পারলে তা খাদ্য নিরাপত্তার সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে। এটি সর্বজনস্বীকৃত যে, কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহনশীলতার কারণে করোনার অভিঘাতে দেশে তেমন কোন খাদ্য সংকট দেখা যাইনি। পরিতাপের বিষয়, তাদের এই অবদানের জন্য অনুপ্রেরণা বা প্রণোদনা না দিয়ে বরং উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি করে কৃষককে নিরাশ করা হচ্ছে। উপকরণের দাম বৃদ্ধির সাথে সমন্বয় করে উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি করলে তা অধিকাংশ জনগোষ্ঠির ক্রয় ক্ষমতার উপর ব্যপক প্রভাব ফেলবে। কাজেই কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যহত রাখতে এবং উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সর্বসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে ইউরিয়া সার ও জালানি তেলের মূল্য পুনঃবিবেচনা করা যেতে পারে। সার্বিক বিবেচনায় ইউরিয়া সারের মূল্য কেজি প্রতি ২-৩ টাকা এবং ডিজেলের মূল্য লিটার প্রতি ১০ টাকা বৃদ্ধি করলে কৃষক তথা সকল স্তরের জনগণ উপকৃত হবে।
লেখকঃ ড. মোঃ ওয়াকিলুর রহমান, অধ্যাপক, গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়