
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদ্ধতি

ড. মোঃ সহিদুজ্জামান
সম্প্রতি মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রাামীণ এলাকা থেকে শহরে মানুষের চলাচল, বেশি বেশি আন্তর্জাতিক ভ্রমণ এবং জলবায়ুু পরিবর্তন মশার বিস্তারকে বাড়িয়েছে। ফলাফলস্বরূপ, মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে বর্তমানে ডেঙ্গু জ্বরে রোগী মারা যাচ্ছে। প্রতিদিনই বাড়ছে এ রোগীর সংখ্যা, বাড়ছে সংক্রমন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ডেঙ্গু জ্বর এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর মশাবাহিত ভাইরাস রোগ হিসেবে বিবেচিত। বিগত ৫০ বছরে বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ৩০ গুণ বৃদ্ধির সাথে এটি সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বলা চলে, ডেঙ্গু জ্বর বিশ্বব্যাপী একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন মানুষ সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে, আক্রান্ত হয় ১০০ মিলিয়নেরও বেশি এবং মারা যায় প্রায় ২৫,০০০ জন । বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে মশাবাহিত রোগের বিস্তার রোধে নজিরবিহীন ভূমিকা পালন করছে ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম। ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম হল অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাধীন কোম্পানিগুলির একটি অলাভজনক গ্রুপ যা বিশ্ব সম্প্রদায়কে ডেঙ্গু, জিকা, হলুদ জ্বর এবং চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগ থেকে রক্ষা করতে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তারা যৌথভাবে কাজ করছে।
বিজ্ঞানিরা বলছেন, মশা পরিবেশের একটি উপাদান। মশা নির্মূল করা যেমন সম্ভব নয় তেমনি উচিতও নয়। আবার মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি জঠিল ও সমন্বিত পদ্ধতি। তাই মশা নিধন নয় ববং মশা দিয়ে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি। ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম এমনিই একটি পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলভাবে মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, জিকা, হলুদ জ্বর এবং চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে সফলতা পেয়েছে।
এডিস এজিপ্টি মশা হল ডেঙ্গু, জিকা, চিকুনগুনিয়া এবং হলুদ জ্বরের ভাইরাসের প্রধান বাহক। এডিস এজিপ্টি মশা প্রাকৃতিকভাবে ওলবাচিয়া নামক এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া বহন করে। শুধু মশা নয়, এই ব্যাকটেরিয়া প্রাকৃতিকভাবে ফলের মাছি, মথ, ড্রাগনফ্লাই এবং প্রজাপতিসহ প্রায় ৬০ শতাংশ কীটপতঙ্গের প্রজাতিতে দেখা যায়। এই ব্যাকটেরিয়া মানুষ, পশু-পাখি এবং পরিবেশের কোন ক্ষতি করে না বরং মশার দেহে ব্যাকটেরিয়াটির উপস্থিতি ডেঙ্গু, জিকা, হলুদ জ্বর এবং চিকুনগুনিয়ার জীবানু বংশবৃদ্ধিতে বাঁধা দেয়। ফলে ওই মশা এসব জীবানু ছড়াতে পারে না।
ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া মশার সংখ্যা দমন সহ বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ওলবাচিয়ায় আক্রান্ত পুরুষ মশা ব্যবহার করে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এই পুরুষ মশা যখন ওলবাচিয়া আক্রান্ত নয় এমন স্ত্রী মশার সাথে মিলিত হয়, তখন তারা প্রজনন করতে অক্ষম হয়। ফলে মশার বংশবৃদ্ধি কমে যায় এবং রোগ নিয়ন্ত্রন সম্ভব হয়।
মশা ও মশা বাহিত রোগ ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে আতঙ্ক সৃষ্টি হত। এখন সারা বছর জুড়ে থাকে এ আতঙ্ক। কারণ শুষ্ক ও আর্দ্র উভয় মৌসুমে এডিস মশা সক্রিয় থাকে, তবে বর্ষার সময় এদের বেশি দেখা যায়। তাই বছরজুড়ে নেওয়া হচ্ছে নানান কর্মসূচি, এসব কর্মসূচীতে ব্যয় করা হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এভাবে মশা নিধনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও কার্যত কতটুকু ফলাফল মিলছে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। এছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ যেহেতু একটি সমন্বিত পদ্ধতি যেখানে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করার প্রয়োজন হলেও আমাদের দেশে অনেকক্ষেত্রেই তা দেখা যায় না। বিশেষ করে মশা নিয়ন্ত্রণের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এক্ষেত্রে দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে তারা একে অপরের উপর দোষ চাপিয়ে সময় পার করে দেয়।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না বরং পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। জনবহুল এই দেশে অব্যবস্থাপনা এবং অসচেতনা ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে দিন দিন জঠিল করে ফেলছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর ২০ হাজারের অধিক মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। এবছর এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রামের মত অধিক কার্যকর, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারাসাইটোলজি বিভাগে এ নিয়ে গবেষণা চলছে। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশে মশার শরীরে ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া সনাক্তকরণে কাছ চলছে। ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেলে তা পরবর্তিতে এডিস এজিপ্টি মশার শরীরে প্রবেশের মাধ্যমে পরীক্ষামূলকভাবে গবেষণাগারে ওলবাচিয়া ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত মশার প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করা হবে। এসব মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত এলাকায় ছেড়ে দিলে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং সেই এলাকায় ডেঙ্গু রোগের সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব হবে।
মশা নিয়ন্ত্রণ ও নিধন একটি টেকনিক্যাল ও বিজ্ঞানসম্মত বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মশা ও অন্য ভেক্টর বা বাহক নিয়ন্ত্রণের জন্য একক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা অনুসন্ধান, নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রযুক্তির সমন্বয়ের মাধ্যমে মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। আমাদেরও সেরকম প্রতিষ্ঠান তৈরি করা দরকার যারা স্বাধীনভাবে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে জবাবদিহিতার সাথে কাজ করে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। টেকসই প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, ব্যবহৃত মশার ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ সহ সব ধরণের সুযোগ সুবিধা রেখে ক্ষমতায়িত করতে পারলে এধরণের প্রতিষ্ঠান থেকে হয়ত ভাল ফল মিলবে। দেশের প্রতিটি জেলায় ও উপজেলায় থাকবে এর শাখা প্রশাখা যারা সারা বছর ধরে এক ছাতার নিচে কাজ করবে।
অধ্যাপক ড. মোঃ সহিদুজ্জামান
লেখক ও গবেষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
You must be logged in to post a comment.