কৃষি-প্রাণী ও মৎস্য চাষিদের করণীয়

নিউজ ডেস্কঃ

ফাল্গুন মানেই যেন অন্যরকম এক আমেজ। আর এই আমেজ সবুজের সমারোহের মোহ বললে ‍ভুল হবে না।চারদিকে কেবল সবুজের সাজ চোখে পড়ছে। এই যেন প্রকৃতির মাথা তুলে তাকানোর অভিপ্রায়। গাছে গাছে নতুন পল্লব আর কিচিরমিচির পাখির ডাক, বাতাসে ভেসে বেড়ানো ফুলের সুবাস নাকে আসা আর কৃষক-কৃষাণীদের ব্যস্ত সময় পার করার প্রস্তৃতি যেন জানান দেয় এখন ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে ধরায়। সব মিলিয়ে ফাল্গুন একদিকে যেমন ছোট-বড় সবার মাঝে আনে প্রকৃতির প্রেম অন্যদিকে কৃষকদের মাঝে আনে অন্যরকম সুখময় ব্যস্ততার প্রয়াস। আজকের এই লেখায় ফাল্গুনে কৃষকদের নানারকম ব্যস্ততা তুলে আনার চেষ্টা করবো।

আসুন জেনে নি, ফাল্গুনে একজন চাষী সফলতা লাভে যে নিয়মে তার চাষাবাদের কাজে ব্যস্ত সময় পার করবেন।

বোরো ধান চাষে একজন কৃষক যা করবে-

ফাল্গুনে ধানের বাড়ন্ত অবস্থা থাকে। এসময় চারার বয়স ৫০-৫৫ দিন হলে জমির আগাছা পরিষ্কার এবং জমি থেকে পানি সরিয়ে ইউরিয়া সারের শেষ কিস্তি উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। আর যদি ক্ষেতে গুটি ইউরিয়া দিয়ে থাকলে ইউরিয়া সারের উপরিপ্রয়োগ করতে হবে না। অবশ্য আপনার মনে রাখতে হবে ধানের কাইচ থোড় আসা থেকে শুরু করে ধানের দুধ আসা পর্যন্ত ক্ষেতে ৩-৪ ইঞ্চি পানি ধরে রাখতে হবে। পোকা দমনের জন্য নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হবে এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে (আলোর ফাঁদ পেতে, পোকা ধরার জাল ব্যবহার করে, ক্ষতিকর পোকার ডিমের গাদা নষ্ট করে, উপকারী পোকা সংরক্ষণ করে, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে পাখি বসার ব্যবস্থা করে) ধানক্ষেত বালাই মুক্ত করতে পারেন। এতে বালাইনাশক লাগবে কম, লাভ হবে বেশি এবং পরিবেশ থাকবে স্বাস্থ্যসম্মত। এসব পন্থায় রোগ ও পোকার আক্রমণ প্রতিহত করা না গেলে শেষ উপায় হিসেবে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সঠিক বালাইনাশক, সঠিক সময়ে, সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে।

গম চাষে যা করতে হবে-

এ মাসের দ্বিতীয় পক্ষ থেকে শুরু হয় গম পাকা। গম শিষের শক্ত দানা দাঁত দিয়ে কাটলে যদি কট কট শব্দ হয় তবে বুঝতে হবে গম কাটার সময় হয়েছে। মাঠে অবস্থিত গম ফসল বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে হলে কাটার আগে মাঠে যে জাত আছে সে জাত ছাড়া অন্য জাতের গাছ সতর্কতার সাথে তুলে ফেলতে হবে। নয়তো ফসল কাটার পর বিজাত মিশ্রণ হতে পারে। সকালে অথবা পড়ন্ত বিকেলে ফসল কাটার পর রোদে শুকিয়ে খুবই তাড়াতাড়ি মাড়াই-ঝাড়াই করে ফেলতে হবে। সংগ্রহ করা বীজ ভালো করে শুকানোর পর ঠাণ্ডা করে সংরক্ষণ করতে হবে।

 

ভুট্টা (রবি) চাষে যা করতে হবে-

জমিতে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ গাছের মোচা খড়ের রঙ ধারণ করলে এবং পাতার রঙ কিছুটা হলদে হলে মোচা সংগ্রহ করতে হবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে শুকনো আবহাওয়ায় মোচা সংগ্রহ করতে হবে। সংগ্রহ করা মোচা ভালোভাবে শুকিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে। মোচা সংগ্রহের পর উঠানে পাট বিছিয়ে তার উপর শুকানো যায় অথবা জোড়া জোড়া বেঁধে দড়ি বা বাঁশের সাথে ঝুলিয়ে আবার অনেকে টিনের চালে বা ঘরের বারান্দায় ঝুলিয়ে শুকানোর কাজটি করে থাকেন। তবে যেভাবেই শুকানো হোক না কেন বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।

 

ভুট্টা (খরিফ) চাষে যা করতে হবে-

খরিফ মৌসুমে ভুট্টা চাষ করতে চাইলে এখনই বীজ বপন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে হবে। ভুট্টার উন্নত জাতগুলো হলো বারি ভুট্টা-৬, বারি ভুট্টা-৭, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-১, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-২, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৩, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৪, বারি হাইব্রিড ভুট্টা-৫ এসব।

পাট চাষে যা করতে হবে-

ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত পাটের বীজ বপনের উপযুক্ত সময়। পাটের ভালো জাতগুলো হলো ও-৯৮৯৭, ওএম-১, সিসি-৪৫, বিজেসি-৭৩৭০, সিভিএল-১, এইচসি-৯৫, এইচ এস-২৪। স্থানীয় বীজ ডিলারদের সাথে যোগাযোগ করে জাতগুলো সংগ্রহ করতে পারেন। পাট চাষের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করে আড়াআড়িভাবে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করতে হবে। সারিতে বুনলে প্রতি শতাংশে ১৭ থেকে ২০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। তবে ছিটিয়ে বুনলে আরেকটু বেশি অর্থাৎ ২৫-৩০ গ্রাম বীজ প্রয়োজন হয়। চারা গজানোর ১৫ থেকে ২০ দিন পর শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করেত হবে। এর ৩০ থেকে ৪০ দিন পর দ্বিতীয়বারের মতো শতাংশপ্রতি ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া সার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে।

শাকসবজি চাষে যা করবেন-

এ মাসে বসতবাড়ির বাগানে জমি তৈরি করে ডাঁটা, কমলিশাক, পুঁইশাক, করলা, ঢেঁড়স, বেগুন, পটোল চাষের উদ্যোগ নিতে হবে। তাছাড়া মাদা তৈরি করে চিচিঙ্গা, ঝিঙা, ধুন্দুল, শসা, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়ার বীজ বুনে দিতে পারেন। সবজি চাষে পর্যাপ্ত জৈবসার ব্যবহার করতে হবে। পরিকল্পিতভাবে জৈবসার ব্যবহার করে শাকসবজি চাষে উদ্যোগ নিতে পারেন।

ফলদ বৃক্ষ চাষে যা করবেন-

এ মাসে আম গাছে মুকুল আসে। গাছে মুকুল আসার পরপরই এ মুকুল বিভিন্ন প্রকার রোগ এবং পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো আমের এ্যানথ্রাকনোজ রোগ। এ রোগ দমনে গাছে মুকুল আসার পর কিন্তু ফুল ফোটার পূর্ব পর্যন্ত আক্রান্ত গাছে টিল্ট-২৫০ ইসি প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি অথবা ২ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন। এছাড়াও কাঁঠালের ফল পচা বা মুচি ঝরা সমস্যা এখন দেখা দিতে পারে। এ রোগের হাত থেকে মুচি বাঁচাতে হলে কাঁঠাল গাছ এবং নিচের জমি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আক্রান্ত ফল ভেজা বস্তা জড়িয়ে তুলে মাটিতে পুঁতে ধ্বংস করতে হবে। অন্যান্য ফল: বাডিং পদ্ধতিতে বরই গাছের কলম করতে পারেন। এজন্য প্রথমে বরই গাছ ছাঁটাই করতে হবে এবং পরে উন্নত বরই গাছের মুকুল ছাঁটাই করে দেশি জাতের গাছে সংযোজন করতে হবে। কলা, পেঁপে বাগানে পরিচর্যা বা যত্নের প্রয়োজনীয় কাজগুলো দেরি না করে এখনই সম্পন্ন করতে ফেলতে পারেন।

মৎস্য চাষে যা করবেন-

মাছ চাষের জন্য পুকুর তৈরি ও সংস্কার করার উপযুক্ত সময় এখন। পুকুরের পানি শুকিয়ে গেলে নিচ থেকে পচা কাদা তুলে ফেলতে হবে এবং শতাংশপ্রতি ১ কেজি চুন ও ১০ কেজি গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করতে হবে। পানি ভর্তি পুকুরে প্রতি শতাংশে ৬ ফুট পানির জন্য ১ কেজি চুন গুলে ঠাণ্ডা করে দিতে হবে। এছাড়া শতাংশ প্রতি ১০ কেজি গোবর, ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি একসাথে মিশিয়ে পানি ভর্তি পুকুরে দিতে হবে। শীতের পর এ সময় মাছের বাড়তি দ্রুত হয়। তাই পুকুরে প্রয়োজনীয় খাবার দিতে হবে এবং জাল টেনে মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে।

প্রাণিসম্পদ খামারিরা যা করবেন-

শীতকাল শেষ হয়ে এখন গরম পড়ছে। এ সময়টা পোল্ট্রি খামারি ভাইদের থাকতে হবে বেশ সতর্ক। কারণ শীতকালে মোরগ-মুরগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কমে যায়। সে কারণে রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমোসিস, ফাউল টাইফয়েড, পেটে পানি জমা এসব রোগ দেখা দিতে পারে এই সময়ে। তাছাড়া ভিটামিন সি ও ভিটামিন ই এর অভাব ও দেখা দিতে পারে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি ও কমে যাওয়ার কারণে বিরূপ আবহাওয়ায় মোরগ-মুরগীর খাবার গ্রহণেও অনীহা দেখা দেয়। এসব সমস্যা সমাধানে টিকা প্রদান, ভিটামিন সরবরাহ করা যেতে পারে।

এছাড়া এই বসন্তে সফলতা অর্জনে আরো বিস্তারিত জানার জন্য কাছের উপজেলা কৃষি অফিস/উপজেলা মৎস্য অফিস/উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস বা কৃষি বিশেষজ্ঞ, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করে জেনে নিতে হবে। এছাড়া কৃষি কল সেন্টারের ১৬১২৩ নম্বরে ফোন করে নেওয়া যাবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।

  •  
  •  
  •  
  •  

Tags: