
জীবনানন্দ দাশের ৬৭ তম প্রয়াণ দিবস আজ

নিউজ ডেস্ক: বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক জীবননান্দ দাশ। তিনি বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অন্যতম। ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জন্ম নেওয়া এই কবির বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন একজন শিক্ষক। মা ছিলেন কবি কুসুম কুমারী দাশ। মায়ের কাছ থেকেই সাহিত্যচর্চা ও কবিতা লেখার প্রেরণা পান জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দের প্রথম কাব্যে নজরুল ইসলামের প্রভাব থাকলেও দ্বিতীয় কাব্য থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী। তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গ ও রূপকথা-পুরাণের জগৎ জীবনানন্দের কাব্যে হয়ে উঠেছে চিত্ররূপময়, তাতে তিনি ‘রূপসী বাংলার কবি’ অভিধায় খ্যাত হয়েছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁকে ‘নির্জনতম কবি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘শুদ্ধতম কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছেন। সমালোচকদের অনেকে তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন।
জীবনানন্দ দাশ প্রধানত কবি হলেও বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ও প্রকাশ করেছেন। তবে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন যার একটিও তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তিনি দিনাতিপাত করেছেন। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধকালে সার্বজনীনভাবে বাংলা কবিতায় তাঁর প্রভাব মুদ্রিত হয়েছে। জীবনানন্দের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে পুরস্কৃত (১৯৫৩) হয়। ১৯৫৫ সালে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থটি ভারত সরকারের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করে। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলো যেমন রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা কাব্যপ্রেমীদের নিকট অত্যধিক সমাদৃত।
১৯২৫ সালের জুনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে জীবনানন্দ দাশ রচনা করেন ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’, যা প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায়। তবে ১৯৫২ সাল থেকে তার কবিতা নিয়মিত ‘প্রবাসী’, ‘বঙ্গবাসী’, ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলম’, ‘বিজলী’, ‘ধূপছায়া’, ‘প্রগতি’ প্রভৃতি পত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। কবির কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ঝরা পালক’, ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহাপৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘রূপসী বাংলা’ এবং ‘বেলা অবেলা কালবেলা’। এ ছাড়া তিনি ‘কবিতার কথা’ শিরোনামে একটি গদ্যগ্রন্থও লিখেছেন। জীবনানন্দের মৃত্যুর পর ছাপা হয় তার উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সতীর্থ’। এ ছাড়াও তার অপ্রকাশিত অনেক রচনা পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে।
১৯৫৪ সালে ১৪ই অক্টোবর, কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় আহত হন তিনি। ট্রামের ক্যাচারে আটকে তার শরীর দলিত হয়ে গিয়েছিল। ভেঙ্গে গিয়েছিল কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড় গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাকে উদ্ধার করে। তাকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ-সহ অনেক তরুণ কবি সুচিকিৎসার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাস এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার অনুরোধেই পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবিকে দেখতে এসেছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন যদিও এতে চিকিৎসার তেমন উন্নতি কিছু হয়নি। তবে কবির অবস্থা ক্রমশ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। গত এক শতকে ট্রাম দুর্ঘটনায় কোলকাতায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র- জীবনানন্দ দাশ।
‘নির্জনতম কবি’ জীবনানন্দ দাশের ৬৭ তম প্রয়াণ বার্ষিকীতে কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। বাংলার ঘরে জীবনানন্দ বেঁচে থাকুক হাজার বছর!
You must be logged in to post a comment.