শিং মাছের জীবন রহস্য উন্মোচন করলেন বাকৃবি গবেষক
নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে প্রথমবারের মতো দেশীয় শিং মাছের জীবন রহস্য বা জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন এবং স্ত্রী-পুরুষ শিং মাছের লিঙ্গ নির্ধারণকারী সম্ভাব্য জিন শনাক্তকরণে সফলতা পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. তাসলিমা খানম ও তার গবেষক দল।
লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিন শনাক্তকরণের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ শিং মাছ উৎপাদন সম্ভব হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন গবেষক তাসলিমা খানম।
গবেষক তাসলিমা খানম বলেন, জাপান সোসাইটি ফর দি প্রমোশন অব সায়েন্সের অর্থায়নে ২০২২-২০২৪ সালে জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সিকোয়েন্সিং কাজটি সম্পন্ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরিকৃত ড্রাফট জিনোম ব্যবহার করে সম্ভাব্য লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিন সনাক্তকরণ সম্ভব হয়েছে যা যেকোনো দেশীয় মাছের ক্ষেত্রে প্রথম।
এই গবেষণার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কিছু মাছের ক্ষেত্রে লিঙ্গভেদে স্ত্রী ও পুরুষ মাছের দৈহিক বৃদ্ধির পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। শিং মাছ এর অন্যতম উদাহরণ। যেখানে স্ত্রী শিং মাছের বৃদ্ধি পুরুষ মাছ অপেক্ষা ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে। এই মাছের বাণিজ্যিক উৎপাদন বাড়ানোর জন্য তেলাপিয়ার ন্যায় মনোসেক্স শিং মাছ উৎপাদনকে অন্যতম উপায় হিসেবে মনে করা হয়। সফলভাবে মনোসেক্স শিং মাছ উৎপাদনের জন্য লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিন সনাক্তকরণ অত্যন্ত জরুরি।
এ পর্যায়ে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা ও খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষায় মনোসেক্স তেলাপিয়ার গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বে মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয় শীর্ষ প্রজাতি হল তেলাপিয়া যার সিংহভাগ আসে মনোসেক্স তেলাপিয়া থেকে। শিং মাছের লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিন শনাক্তকরণের ফলাফল ব্যবহার করে মনোসেক্স শিং মাছও উৎপাদন করা সম্ভব। যা শিং মাছের বাণিজ্যিক চাষে বিপ্লব ঘটাবে বলে মনে করি।
মনোসেক্স শিং মাছ উৎপাদন সম্পর্কে এই গবেষক আরও বলেন, লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিন শনাক্তের ফলে প্রচলিত পদ্ধতির পরিবর্তে মার্কার অ্যাসিসটেড সিলেকশনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে মনোসেক্স শিং মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি শিং মাছ প্রজননক্ষম হওয়ার অনেক আগেই স্ত্রী ও পুরুষ মাছ শনাক্তকরণ সম্ভবপর হবে যা প্রচলিত সিলেকটিভ ব্রিডিং প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। শিং মাছের জিনোম থেকে শুধুমাত্র লিঙ্গ নির্ধারণকারী জিনই নয়, অন্যান্য বৈশিষ্ট্য যেমন দৈহিক বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য দায়ী জিন সনাক্তকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মানব স্বাস্থ্যে ও অর্থনীতিতে শিং মাছের গুরুত্ব উল্লেখ করে গবেষক তাসলিমা বলেন, উন্নতমানের আমিষ, ক্যালসিয়াম ও আয়রনসমৃদ্ধ, কম কাঁটা ও স্বল্প চর্বিযুক্ত হওয়ায় এই মাছটি পুষ্টি ও ঔষধি গুণাগুণের জন্য বিশেষভাবে সুপরিচিত।
তিনি আরও বলেন, ২০২০-২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী স্বাদুপানির মোট উৎপাদিত মাছের ২ দশমিক ৫২ শতাংশ এসেছে শিং ও মাগুর মাছ থেকে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ সংগ্রহ করে বাকৃবির মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদে প্রজননের এর মাধ্যমে মাছের সর্বমোট ৪০টি পরিবার তৈরি করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত ৮টি পরিবার টিকে ছিলো এবং তা থেকে ৮০০টি পোনার নমুনা সংগ্রহ করা হয় বলে জানান তিনি।
গবেষণা প্রকল্পটির ফলাফল জাপানিজ সোসাইটি অফ ফিশারিজ সায়েন্স আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থাপন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। তাসলিমা খানমের নেতৃত্বে গবেষক দলে ছিলেন বাংলাদেশ, জাপান ও সুইডেনের একদল গবেষক।
গবেষণার বিষয়ে বাকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী বলেন, শিং মাছ রোগীর পথ্য হিসেবে পরিচিত। আমরা জানি পুরুষ মাছ সচারচর বেশি শক্তিশালী হয় মেয়ে মাছের তুলনায়। কিন্তু শিং মাছে তার বিপরীত। শিং মাছের ক্ষেত্রে মেয়ে মাছ বেশি শক্তিশালী হয়। মেয়ে মাছগুলো বেশি নির্বাচন করা গেলে বেশি উৎপাদন করানো যাবে। লিঙ্গ নির্ধারণ করার মাধ্যমে সহজেই তা করা সম্ভব হবে।