
কোরবানি কি এবং কেন?

ধর্ম ডেস্কঃ
সামনেই আসছে কোরবানির ইদ বা ইদুল আযহা। আমরা নিয়মিত কোরবানির ইদ পালন করলেও কোরবানির উদ্দেশ্য ও এর ফলাফল সম্পর্কে অনেকেই অবগত নই।
উর্দূ ও ফার্সিতে কোরবানি শব্দটির ব্যবহার হলেও এটি করব বা কোরবান আরবি শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ– ‘নৈকট্যবা সান্নিধ্য’। কোরবান হলো, প্রত্যেক সেই বস্তু, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। আর সেখান থেকেই ফার্সি বা উর্দু–বাংলাতে ‘কোরবানি’ শব্দটি গৃহীত হয়েছে।
আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার আশায় জিলহজ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত কোরবানির নিয়তে উট, গরু–মহিষ ও ছাগল–ভেড়া জবাই করাই হলো কোরবানি। আর এ পশুর পশম যতবেশিই হোক না কেন, প্রতিট পশমের বিনিময়ে রয়েছে একটি করে সওয়াব।
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোরবানি তোমাদের পিতা হজরত ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর সুন্নাত।(কোরবানির জন্তুর) প্রতিটি লোমের (পশমের) পরিবর্তে নেকি রয়েছে।-(মুসনাদে আহমদ, ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
মুমিন মুসলমানের জন্য নির্ধারিত দিনে কোরবানি করা মহান আল্লাহর নির্দেশ। কোরআন–সুন্নার নির্দেশনাও তাই। আল্লাহতাআলা বলেন–
‘অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামাজ পড় এবং কোরবানি কর।’ (সুরা কাউসার : আয়াত ২)
নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোরবানি করা প্রসঙ্গে হাদিসে একাধিক বর্ণনা রয়েছে। তাহলো–
১. হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দীর্ঘ (ও সুন্দর) দুই শিং বিশিষ্ট সাদা–কালো মিশ্রিত (মেটে বা ছাই) রঙের দুইটি দুম্বা কোরবানি করেছেন।’ (বুখারি, মুসলিম)
২. হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ১০ বছর মদিনায় অবস্থানকরেছেন। মদিনায় অবস্থানকালীন প্রত্যেক বছরেই কোরবানি করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, তিরমিজি)
৩. সামর্থ্যবানদের মধ্যে যারা কোরবানি করে না, তাদের প্রতি তিনি এভাবে হুশিয়ারী করেছেন। হাদিসে এসেছে–
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কোরবানি করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদেরঈদগাহের ধারে–কাছেও না আসে।’ (মুসনাদে আহামদ, ইবনে মাজাহ, মুসতাদরেকে হাকেম)
৪. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো বছর কোরবানি থেকে বিতর থাকেননি। তিনি কর্মে দ্বারা যেমন কোরবানিকরতে অনুপ্রাণিত করেছেন আবার বক্তব্য দিয়ে কোরবানির প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। হাদিসে এসেছে–
‘যে ব্যক্তি (ইদের) নামাজের আগে (পশু) জবেহ করে সে নিজের জন্য জবেহ করে। আর যে নামাজের পর জবেহ করে তারকোরবানি সিদ্ধ হয় এবং সে মুসলমানদের তরিকার অনুসারী হয়।’ (বুখারি)
মুসলিম উম্মাহ এ ব্যাপারে একমত যে, কোরবানি কোরআন–সুন্নার নির্দেশ ও পালনীয় ইবাদত। এ ব্যাপারে কারো কোনো বিরোধনেই। তবে কোরবানি করা ওয়াজিব না সুন্নাত; এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যে কারণে সম্পদের মালিকের জন্য অনেক ইসলামিকস্কলারগণ কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে মতামত দেন। আবার অনেক সাহাবা, তাবেঈ, তাবে–তাবেঈ এবং ইসলামিকস্কলারগণ কোরবানিকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেছেন।
কোরবানি মুসলিম উম্মাহর আদর্শ ও ঐতিহ্য
কোরবানির ইতিহাস অতি প্রাচীন। কোরআনে হাবিল–কাবিলের ঘটনাই তার প্রমাণ। ইসলামে প্রথম কোরবানি এটি। হাবিলপ্রথম মানুষ, যিনি আল্লাহর জন্য একটি পশু কোরবানি করেন। ধর্মীয় বিবরণ থেকে জানা যায়, হাবিল একটি ভেড়া এবং তারভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন।
সে সময় আল্লাহর নির্ধারিত শরিয়ত বা পদ্ধতি ছিল এই যে, আকাশ থেকে আগুন নেমে আসবে এবং যার কোরবানি কবুল হবেতার জিনিসকে আগুন গ্রহণ করবে। অর্থাৎ অগুন সে জিনিসকে জালিয়ে ভষ্ম করে দেবে। সেই অনুযায়ী, আকাশ থেকে নেমেআসা নেককার হাবিলের জবেহকৃত পশুটির কোরবানি গ্রহণ করে। অন্যদিকে কাবিলের ফসলস্বরূপ প্রদত্ত কোরবানি প্রত্যাখ্যাতহয়।
পরবর্তীতে আল্লাহ তাআলা ইসলামের নবি ও রাসুল, মুসলিম জাতির পিতা, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সাল্লামকে স্বপ্নযোগেএ মর্মে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু কোরবানি করার নির্দেশ দেন, ‘তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি করো। হজরতইবরাহিম আলাইহিস সালাম আদিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর জন্য ১০টি উট কোরবানি করেন। কিন্তু পুনরায় তিনি কোরবানিকরার জন্য আদেশ প্রাপ্ত হন। তখন তিনি আবারও ১০০টি উট কোরবানি করেন।
তারপরেও তিনি একই আদেশ পেয়ে ভাবলেন, আমার কাছে তো এ মুহূর্তে সবচেয়ে প্রিয়বস্তু হলো– পুত্র ইসমাইল আলাইহিসসালাম। এছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই। তখন তিনি হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে কোরবানি করতে মিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। যখন হজরত ইবরাহিম তার পুত্রকে কোরবানি দেওয়ার জন্য গলায় ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখনতিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে ইসমাইল আলাইহিস সালামের পরিবর্তে একটি প্রাণী কোরবানি হয়েছে এবং তার কোনো ক্ষতিহয়নি।
ঐতিহাসিক এই ধর্মীয় ঘটনাকে স্মরণ করে সারাবিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য প্রতি বছরঈদুল আজহা উৎসব পালন করে। ইসলামে হিজরি ক্যালেন্ডারের ১২তম চন্দ্রমাস জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে ১২ তারিখসূর্যাস্ত পর্যন্ত কোরবানি করার সময় হিসাবে নির্ধারিত। এ দিনে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি দেন।
তাই মুসলিম উম্মাহর জন্য এটা উত্তম যে, সামর্থ্য থাকলে কোরবানি আদায় করাই উত্তম। কোনোভাবেই কোরবানি থেকে বিরতনা থাকা। সক্ষম হলে নিজের ও পরিবার–পরিজনের পক্ষ থেকেও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করা। এর মাধ্যমে যেমনআল্লাহর নির্দেশ মানা হয় তেমনি সাহাবাদের অনুসরণ ও অনুকরণও হয়। ফলে এতে রয়েছে বিশাল সওয়াবের হাতছানি।
কোরআন–সুন্নার এসব দিকনির্দেশনা থেকে প্রমাণিত যে–
কোরবানি অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ইবাদত। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে অর্থ খরচ করে স্বার্থ ত্যাগ করে এ ইবাদত করতে হয়। কোরবানিরপর পরিবার ও দরিদ্রজনের উপর কোরবানির পশুর গোশত খরচ করা হয় এবং আত্মীয়–স্বজন ও বন্ধু–বান্ধবদের জন্য হাদিয়া ওউপঢৌকন পেশ করার সুযোগ হয়। কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্য করতে পেরেই মুমিন মুসলমান আনন্দ পেয়ে থাকে।মুমিনের সেই খুশিই হলো কোরবানির খুশি।
কোরবানি না করে কোরবানির টাকা গরিব–দুঃখীর মাঝে বণ্টন করে দিলে কোরবানির হক আদায় হবে না। কারণ কোরবানিতেআল্লাহর জন্য পশু জবাই করা হলো ইবাদত ও দ্বীন ইসলামের নির্দশন এবং প্রতীক। এ কারণেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন–
‘কোরবানি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ এবং সমগ্র মুসলিম জাতির এক আমল। আর কোথাও কথিতনেই যে, তাঁদের কেউ কোরবানির পরিবর্তে তার মূল্য সাদকাহ করেছেন। আবার যদি তা উত্তম হতো তবে তাঁরা নিশ্চয়ই তারব্যতিক্রম করতেন না।’ (ফাতাওয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া)
মনে রাখতে হবে
কোরবানি দ্বারা জবাই উদ্দেশ্য। সুতরাং পশু জবাই করা কোরবানির মূল্য সাদকাহ করা অপেক্ষা উত্তম। যদিও সে তা কোরবানিরচেয়ে পরিমাণে বেশি হয়।
সুতরাং কোরআন–সুন্নার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী অর্থ দিয়ে নামাজ ও কোরবানির ইবাদত আদায় করলে হবে না। এর অন্যতমপ্রমাণ হলো– হজের ক্ষেত্রে যারা তামাত্তু ও কিরান হজ করবেন, তারা যদি কোরবানির পরিবর্তে তিনগুণ বা তারচেয়েও বেশিসাদকাহ করে তাতে তার বিনিময় হবে না। ঠিক কোরবানিও তাই। আর আল্লাহ তাআলাই বেশি জানেন।
কোরবানি নামাজের মতো স্বাতন্ত্র ইবাদত। কোরআন–সুন্নাহর আলোকে কোরবানির গুরুত্ব, ফজিলত ও সাওয়াব অনেক বেশি।আর এটা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নাত হওয়ার কারণেই নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তাপালন করেছেন। সে কারণে তা উম্মতে মুহাম্মাদির সামর্থ্যবানদের জন্যও আদায় করা আবশ্যক।
You must be logged in to post a comment.