কভিড-১৯-এর প্রভাব প্রাণিজগতের ওপর

নিউজ ডেস্কঃ

কভিড-১৯ মহামারীতে বিপর্যস্ত এক সময় পার করছে গোটা পৃথিবী। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সংক্রমণ ও মৃত্যুর খবর সামনে আসতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক অতীতে মানবসভ্যতাকে এত বড় হুমকির মুখে আর কখনই পড়তে হয়নি। এ মহামারীর কারণে গোটা বিশ্ব দীর্ঘ সময় লকডাউনে বন্দি হয়ে পড়েছিল। সবচেয়ে আশঙ্কার খবর সংক্রমণের সংখ্যা অতি দ্রুত কমবে বলেও মনে হচ্ছে না। তবে মানুষের জন্য এ মহামারী যতটা বিপদ সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, প্রাণিকুলের জন্য হয়তো ততটা নয়। আক্রান্ত পশুর সংখ্যা চাইলে হাতেই গুনে নেয়া যায়। সিংহ, বাঘ, মিঙ্ক, গৃহপালিত বিড়াল ও কুকুর আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যদিও সংখ্যার দিক থেকে তা এখনো আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু না।

ধারণা করা হচ্ছে, পোষা প্রাণীগুলো কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে নিজেদের মালিকদের কাছ থেকে। চিড়িয়াখানায় বাঘ সিংহ আক্রান্ত হতে পারে, যারা সেখানে তাদের দেখাশোনা করে তাদের কাছ থেকে এবং বেজি জাতীয় মিঙ্ক নামের প্রাণীগুলো হয়তো পশমের খামারে কাজ করা শ্রমিকদের কাছ থেকে সংক্রমিত হয়েছে। কিংবা তারা অন্য কোনো সংক্রমিত প্রাণী থেকেও আক্রান্ত হতে পারে।

কর্নেল ইউনিভার্সিটির অ্যানিমেল হেলথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ভাইরোলজিস্ট ডিয়েগো ডিয়েল বলেন, নভেল করোনাভাইরাস নামক প্রাণঘাতী এ ভাইরাস মূলত জুনোটিক ভাইরাস, যা প্রাণী দ্বারা সৃষ্ট। পরে তাদের দেহ থেকে মানুষের দেহে সে ভাইরাস স্থানান্তরিত হয়ে থাকে।

তার মতে, মানুষের মাধ্যমে ছড়ানো ভাইরাস যদি প্রাণীদের স্বাস্থ্যের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো হুমকি সৃষ্টি করত তবে আমরা এর মধ্যেই জানতে পারতাম।

যদিও এখনো অনেক কিছু পরিষ্কার নয়। এমন কোনো প্রমাণ এখন পর্যন্ত মেলেনি যার মাধ্যমে বলা যায়, ঘরে পোষা প্রাণী মানুষের শরীরে ভাইরাস ছড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও মনে রাখা জরুরি যে প্রাণীদেহে ভাইরাস থাকার ব্যাপারে বিস্তৃত কোনো পরীক্ষাও এখন পর্যন্ত করা হচ্ছে না। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া স্কুল অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের মাইক্রোবায়োলজিস্ট শেলি রানকিন বলেন, আমরা কি সব ধরনের বিড়াল ও কুকুরের পরীক্ষা করে দেখেছি, যাদের শ্বাসতন্ত্রের উপসর্গ রয়েছে? হয়তো আগামী ১২ মাসের মধ্যে আমরা করতে পারব।

ডিয়েলের মতে, একমাত্র পরীক্ষামূলক ইন-ভিভো গবেষণার মাধ্যমেই আমরা জানতে ও নির্ধারণ করতে পারব যে বিভিন্ন প্রজাতিগুলো ভাইরাসের সংস্পর্শে আসার পর অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য কতটা সংবেদনশীল।

বাঘ বিশ্বে প্রথম আক্রান্ত প্রাণী

এপ্রিলেই প্রথম খবর আসে নিউইয়র্কের ব্রোনক্স চিড়িয়াখানায় নাদিয়া নামে একটি চার বছর বয়সী বাঘ কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছিল। এ খবর করোনার প্রাদুর্ভাবের মাঝে নতুন মাত্রা যোগ করে। কারণ এটিই ছিল বন্যপ্রাণীর আক্রান্ত হওয়ার প্রথম ঘটনা। তবে এ ঘটনা এখানেই থামেনি। পরবর্তী সময়ে চিড়িয়াখানার আরো চারটি বাঘ করোনায় সংক্রমিত হয়।

সে সময় জানা যায়, আক্রান্ত বাঘগুলোর কাশি ও শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত সমস্যা ছিল। এ বাঘগুলোর সংক্রমিত হওয়ার উৎস ছিল উপসর্গহীনভাবে আক্রান্ত একজন জু-কিপার, যিনি বাঘগুলের দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। চিড়িয়াখানা অবশ্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল আরো আগেই। এ ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বিড়ালদের ঝুঁকি

বিড়ালকে সাধারণ করোনাভাইরাসের জন্য সংবেদনশীল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর মাঝে ইউরোপ, এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেকগুলো বিড়ালের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যেখানে একটি ছাড়া সবাই কাছাকাছি থাকা মানুষ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, যারা আগেই সংক্রমিত ছিল। অন্যটি ছিল একটি বাইরের বিড়াল, যেটি এলাকার ভেতর কোনো স্থানে আক্রান্ত হয়েছিল।

খামারে সংক্রমিত মিঙ্ক

নেদারল্যান্ডস, স্পেন, ডেনমার্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো পশম খামারের মিঙ্ক (বেজি জাতীয় জন্তু) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর এরই মধ্যে জানা গেছে। এ খবর অবশ্য সংশ্লিষ্টদের মাঝে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি করে। প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপে হাজারো আক্রান্ত মিঙ্ককে মেরে ফেলা হয় ভাইরাসের বিস্তৃতি রোধ করার জন্য। এমনকি এ ঘটনার পর নেদারল্যান্ডস স্থায়ীভাবে মিঙ্ক খামারগুলোও বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। রফতানিতে এগিয়ে থাকা দেশটি এ সময় প্রায় ৫ লাখ মিঙ্ককে হত্যা করে। অথচ মিঙ্ক রফতানিতে চীন, ডেনমার্ক ও পোল্যান্ডের পরই ছিল ডাচদের অবস্থান।

আক্রান্ত পশুর রাজা সিহংও

ব্রোনক্স চিড়িয়াখানায় বাঘ আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি তিনটি সিংহও আক্রান্ত হয়েছিল। একাধিক ল্যাবে পরীক্ষার মাধ্যমে সিংহগুলোর আক্রান্ত হওয়ার খবরটি নিশ্চিত করা হয়। বাঘগুলোর মতো সবগুলো সিংহও একজন উপসর্গহীন জু-কিপারের কাছ থেকে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল। বাঘ ও সিংহের ভাইরাসের আক্রান্ত হওয়ার খবর কপালে ভাঁজ ফেলেছিল বিশেষজ্ঞদের।

কুকুরের ভিন্ন ধরনের ফলাফল

জুনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো একটি জার্মান শেফার্ডের কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। সে কুকুরটিও অন্যান্য গৃহপালিত প্রাণীর মতো তাদের মালিক দ্বারা সংক্রমিত হয়েছিল বলে জানা গেছে। তবে পরে জুলাইয়ে আক্রান্ত সে প্রথম কুকুরটি লিমফোমা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তার মৃত্যু নতুন একটি প্রশ্ন নিয়ে সামনে আসে। তবে কি কিছু প্রাণী, যাদের অন্যান্য শারীরিক সমস্যা আছে, তারা কভিড-১৯-এর জন্য অধিক সংবেদনশীল? যদিও এসব

প্রশ্নের নিশ্চিত কোনো উত্তর এখনো জানা যায়নি। বিস্তৃত পরীক্ষা ও গবেষণার পরই হয়তো প্রাণীদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার তীব্রতার ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  

Tags: